২০১৬ সালে সন্ত্রাসবাদের রূপ কেমন হবে?
2015.12.30

২০১৬ সালে বিশ্বে এককভাবে আইসিস হয়ে উঠবে বৃহত্তর সন্ত্রাসের হুমকি।
নতুন বছর সম্ভবত ৫টি ইঙ্গিতপূর্ণ পরিস্থিতি বয়ে আনবেঃ প্রথমত,সিরিয়া ও ইরাকের বাইরে আইসিসের বিস্তার ঘটবে আফ্রিকার একটি অংশে, মধ্যপ্রাচ্যে,বলকান অঞ্চলে, ককাশাস অঞ্চলে ও এশিয়ায়।
আবু বকর বাগদাদীর নেতৃত্বাধীন চরমপন্থি দলটি সক্রিয়ভাবে সদস্য সংগ্রহ করছে পশ্চিম বলকান, সার্বিয়া,বসনিয়া-হার্জেগভিনিয়া,আলবেনিয়া,কসভো,মেসেডোনিয়া ও মন্টেনেগ্রো এসব এলাকায় তারা হামলার পাঁয়তারা করছে।
একইভাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পূর্ব-ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ ফিলিপাইন্সের একটি অংশকে আগামি বছর তাদের প্রদেশ ঘোষণার লক্ষ্যে ঐ অঞ্চলে লোকবল গড়ে তুলছে।
২০১৫ সালে সিরিয়া ভিত্তিক কাতিবাহ নুসান্তারা আইসিসের কমান্ডার মালয়-ভাষি ইউনিটকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় লোকবল সংগ্রহ করে ওই এলাকায় আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্যবস্তুতে ২০১৫-১৬তে হামলা চালাতে বলেছে।
একই সঙ্গে আইসিস ঘোষণা করতে যাচ্ছে চীনের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে নতুন প্রদেশ। সেখান থেকে অন্তত ১০০০ উরুঘুয়ে মুসলিম আইসিস ও আলকায়দা সহ সিরিয়ায় যুদ্ধে যোগ দিয়েছে।
আরো বহিরাক্রমনের আশংকা
দ্বীতিয়ত, আইসিস তাদের বিরোধী জোটের লক্ষ্যে আঘাত হানবে। যেমন প্যারিসে হামলা করলো তাদের বিদেশ ইউনিট। যেখানে স্থানীয় ও বিদেশ ইউনিট একসাথে কাজ করেছে।
২০০৮-এর মুম্বাই-এর ধরনের বা আল-কায়দার ৯/১১ এর মতো করে আত্নঘাতী আক্রমন প্যারিসে ঘটিয়েছিলো, তেমন ঘটনা আরো ঘটানো হতে পারে।
অন্যান্য ঘটনা
তৃতীয়ত, ব্যাপক পর্যায়ে সিরিয়ার শরনার্থীরা ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আইসিস এই ঘটনার সুযোগ নিয়ে এইসব দেশে ঢুকে পড়ে আক্রমন চালাতে পারে, সে আশংকা দেখা দিয়েছে। মধ্য বা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পিতভাবে সে হামলা হতে পারে।
চতুর্থত, আইসিস অনলাইনে অনেক প্রচারনার মাধ্যমে যে লোকবল সংগ্রহ করছে তা শুধু মুসলিম দেশে নয় অমুসলিম দেশেও চলছে, এটা আরও ব্যাপক আকারে নতুন অভিবাসীদের মধ্যে আইএস বিরোধী ঘৃণার সুযোগ নিয়ে নিজেদের মূলধারার ইসলাম দাবী করে যাবে।
ইউএস ও ইউরোপিয়ান সার্ভারগুলোতে আইএসের ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সোশাল মিডিয়া চালু আছে। তারা সেখানে প্রচারনা চালাচ্ছে। দেশগুলোর নেতৃত্ব ও উদ্যোগের ঘাটতির কারণে আইসিস এই প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করছে।
পঞ্চমত, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে, সৌদি নেতৃত্বে ও রাশিয়ার নেতৃত্বে জোটগুলো নিজেরা এক হয়ে আইসিস বিরোধী অভিযান চালাবে না, তবে তারা গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করে নিজেদের কার্যক্রম আরো সুচারুভাবে চালিয়ে আইসিসকে নির্মূল করতে পারে।
আইসিস প্রভাবিত এলাকা
যে সব এলাকায় সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে সে সব এলাকায় আইসিস ইতিমধ্যে নিজেদের বিস্তার ঘটিয়েছে।
আফগানিস্থানে তালিবানরা ১৩টি প্রদেশে আক্রমন জোরদার করেছে এবং ১৫ জেলা দখলে নিয়েছে। মোল্লা ওমরের মৃত্যুর পর তালিবানের বিভক্তি দেখা দেয়, কোনো কোনো জায়গায় আইসিস পন্থিরা শুন্যতা পূরন করেছে। পাকিস্তানের কাছে নাঙ্গারহার প্রভিন্সে আইসিস পন্থিদের দখলে চলে গেছে।
সেখানে থেকে এখন তারা প্রভাব বিস্তার করছে। অদূর ভবিষ্যতে আইসিস সেখানে প্রধান বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের পর নানা রকম সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। তারমধ্যে মজলিস সুরা শাবাব আল ইসলাম ও আনসার আল শারিয়া আইসিসের খলিফা আল বাগদাদীর আনুগত্য প্রকাশ করেছে। সেখানে আইসিসের প্রভিন্স ঘোষণা করা হয়েছে।
নাইজেরিয়ায় বোকা হারাম ইতিমধ্যে আল-বাগদাদীর অনুগত হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আলজিরিয়া ও ইয়েমেনে প্রভিন্সের নাম দেয়া হয়েছে উইলিয়াদ আল জাজায়ের, সৌদি আরবকে উইলিয়াদ হারামায়েন নাম দেয়া হয়েছে। আইসিস পন্থিরা ইয়েমেনের হুথিদের বিরুদ্ধে কয়েকটি আক্রমন করেছে বলে দাবি করেছে।
ইয়েমেনের সানায় গত মার্চে জায়দি মসজিদে সাদায় ও সরকারি ভবনে বোমা হামলা করে ১৩৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে আহত হয়েছে ৩৪৫ জন।
আইসিস সৌদিতে মুসলিম পবিত্র দুই স্থান মক্কা ও মদিনা দখল নেয়া ঘোষণা দিয়েছে এবং জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদ আক্রমন করবে জানিয়েছে।
সৌদির দুই প্রদেশ নাজদ ও হেজাজে কয়েকটি আক্রমন চালিয়েছে আইসিস। ২০১৬তে ইয়েমেন ও সৌদিতে থাকা আইসিস সেলগুলো দুই দেশেই আক্রমন জোরদার করতে পারে।
উওর ককাশাসে জুন থেকেই নিজেদের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে। সেখানকার আলকায়দা পন্থি নেতা রুস্তম আসিলদারভের সঙ্গে আইসিস কাজ শুরু করেছে।
মিশরে সব চেয়ে মারাত্নক গ্রুপ আনসার বাইত আল মাকদিস। তারা বাগদাদীর অনুসারি। সিনাই অঞ্চলে প্রভাব তাদের। নিরাপত্তা বাহিনীর উপর এরা কয়েক দফা হামালা চালিয়েছে। সেখানে রাশিয়ার বিমান ভুপতিত করার দাবি করেছে তারা।
২০১৬ তে আইসিস পশ্চিমা দেশে রাশিয়ায় এবং শিয়াদের উপর হামলা চালাতে পারে।
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
আজ সিরিয়া-ইরাকের আইসিস বহুমুখি তৎপরতায় বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে তাদের অনুগত দল ও শাখাগুলির মাধ্যমে এবং অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে।
এই হুমকি প্রতিহত করতে নতুন দক্ষতা দরকার। সামরিক বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। নতুন আইনের প্রয়োজন পড়বে। সাইবার আক্রমন ঠেকাতে হবে আর যৌথভাবে কাউন্টার টেরোরিজম উদ্যোগ নিতে হবে।
আইসিস নেতারদের আটক করার ও হত্যা করার দক্ষতা বাড়াতে হবে। তাদের সাপোর্ট বেইজ ভেঙ্গে দিতে হবে। তা করতে হবে সিরিয়া ও ইরাক ছাড়াও অন্যত্র সব খানে। কার্যকর বিমান হামলা ও ভুমিতে বিশেষ সেনা নিয়োগ করতে হবে এইসব অপারেশনের জন্য।
তবে ভুমিতে সামরিক অভিযানের জন্য প্রবল রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। ৯/১১ এর মত বড় হামলার আগেই তাদেরকে সংকুচিত করে ফেলতে হবে। আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে দ্রুত তাদেরকে আটক বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করতে হবে।
ইরাক-সিরিয়ায় আইসিসের মূল ঘাটি গড়ে উঠলেও এর সেটেলাইট অঞ্চলগুলোতে তাদের প্রভাব খর্ব করতে হবে।
প্রত্যক্ষ ও অনলাইন উভয় হুমকি মোকাবেলা
প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতি ও সাইবার স্পেসে কার্যক্রমের মাধ্যমে আইসিস নিজেদের বিস্তার ঘটাচ্ছে।
সরকারগুলোকে আইনের মাধ্যমে ও প্রযুক্তিগতভাবে এই সাইবার তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। ব্যবসায়ী, সিভিল সোসাইটি ও কমিউনিটির মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের আদান-প্রদানের মাধ্যমে ও সোশাল মিডিয়ায় প্রচারনার মাধ্যমে আইএস’র প্রপাগান্ডা ঠেকাতে হবে।
একাডেমিক ও প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তুলে আরো আধুনিক প্রযুক্তিগত উপায় বের করে আইসিসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
যারা আইসিসে যোগ দিচ্ছে বা যারা সমর্থন যোগাচ্ছে বা র্যাডিক্যালাইজ হচ্ছে তাদের জন্য পূনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এইভাবে জাতীয়, আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপি যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আইসিসের মতো অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এর ব্যর্থতায় তারা ধর্মিয় ও আঞ্চলিক কমিউনিটিকে ধ্বংশ করে সারা বিশ্বকেই নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেবে।
*রোহান গুণারত্ন সিঙ্গাপুরে এস রাজারত্নম স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর পলিটিক্যাল ভায়োল্যান্স এন্ড টেরোরিজম রিসার্চ-এর প্রধান হিসেবে কর্মরত।
*মন্তব্য প্রতিবেদন মূলত লেখকের নিজস্ব, বেনার নিউজের মতামত নয়।