স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দি: দুই পথের মোহনায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ
2021.12.13
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের পথযাত্রা যেন এক গোলকধাঁধা। একদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য, অন্যদিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতান্ত্রিক মানদণ্ড থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে গেলেও তা থেকে দেশ লাভবান হতে পারবে কি-না তা এখনো একটি অমিমাংসিত প্রশ্ন।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময় এটি মনে রাখা দরকার যে, যখন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিষয়টি খুব কম মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এই নতুন দেশ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্ত্রের সহজলভ্যতার কারণে পরবর্তীতে অরাজকতা তৈরি হতে পারে বলে অনেকের উদ্বেগ ছিল, দেশটি ‘তলাহীন ঝুড়ি’তে পরিণত হতে পারে বলে মারাত্মক ভবিষ্যৎবাণীর প্রতিধ্বনিও করেছেন অনেকে। কিন্তু সেসব ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে, বিশ্লেষকদের বোকা বানিয়ে বাংলাদেশ শুধু টিকেই থাকেনি, বরং নানাভাবে উন্নতিও করেছে।
বিশ্বাঙ্গনের নীতিনির্ধারকেরা আজ বাংলাদেশকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, বিশ্বমঞ্চে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন ভূমিকার প্রশংসা হয়, বাংলাদেশকে- উপেক্ষার সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক বাঁক বদল এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব - সাম্প্রতিক সময়ে এই তিন কারণে মনোযোগ আকর্ষণ করছে বাংলাদেশ।
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সেবাখাত অভিমুখী অর্থনীতি, সাহায্য-নির্ভরতা থেকে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ এবং গ্রামীণ থেকে নাগরিক সমাজে দেশটির ধীর-স্থির রূপান্তর প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট অনেক প্রতিকূলতার মুখেও দেশটির জনগণের টেকসই অবস্থানের সাক্ষ্য।
গতিশীল অর্থনীতি
জন্মের প্রথম দুই দশক, ১৯৭০ ও ৮০র দশকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ অনেকটা প্রাকৃতিক এবং রাজনৈতিক দুর্যোগের সমার্থক শব্দ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। একটি দুর্ভিক্ষ এবং মাঝে মাঝেই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় দেশকে বিধ্বস্ত করেছিল। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল মারাত্মক মন্থর। সামরিক অভ্যুত্থান ও নেতাদের হত্যাসহ রাজনৈতিক উথালপাতাল ঘটনা বারবার ঘটছিল বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের জনমনে একটি গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশের স্বপ্ন লালিত হলেও বারবার তা সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃত্ববাদ দ্বারা দলিত হয়েছে। তবু এই অস্থিরতার সময়েই দেশটি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের উন্নতির অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলন এবং বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কার্যক্রম।
মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বল্পমেয়াদী শ্রম অভিবাসন এবং তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদকে পরিণত হয়ে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় স্থান তৈরি করাসহ নানা উপায়ে বৈশ্বিক অর্থনীতির সাথে বাংলাদেশের সংযুক্তি ঘটেছে।
দ্বিতীয় দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশে একটি সামাজিক রূপান্তর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। এসময় নারীরা ব্যাপকভাবে শ্রমবাজার এবং অর্থনীতির মূল স্রোতধারায় প্রবেশ করতে শুরু করেন। নগরায়নের গতি বাড়ে এবং অর্থনীতি আরো বিশ্বায়িত হয়ে ওঠে।
তৃতীয় দশকে গণতন্ত্রায়ণের সূচনা হলে শুধু রাজনৈতিক দৃশ্যপটই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে ছিল উচ্চহারে।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২০ সালে করোনা মহামারির অভিঘাত আসার আগ পর্যন্ত পর্যন্ত এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনীতি ৬ শতাংশেরও বেশি হারে বাড়ছিল। এই প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক সূচকের উন্নয়নও ঘটেছে। যেমন, শিক্ষার সম্প্রসারণ, এবং মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার দ্রুত হ্রাস। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক প্রতিবেশী দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
এসব সাফল্য দেশটিকে ২০১৫ সালে একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে অভিষিক্ত করেছিল, যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে চলেছে।
গণতন্ত্রের বিপরীতযাত্রা
দুর্নীতি’র প্রাবল্যের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নিষ্কলুষ নয়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ জনসাধারণের মঙ্গলে ব্যবহারের পরিবর্তে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর নিজেদের লোকজনকে দেয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে।
এই দুই দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণীয় বিষয় হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে বিপরীতমুখিতা। একদিকে দেশটি ক্রমাগত অপশাসন এবং হিংসাত্মক ও সংঘাতময় রাজনীতির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে।
এত কিছুর পরেও কার্যত একটি দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রেখেছিল। নিয়মিত সুষ্ঠু নির্বাচন, ক্ষমতার পরিবর্তন, মতপ্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতা, একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজের উপস্থিতি এবং একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রতিশ্রুতি নাগরিকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার এবং তাদের কণ্ঠস্বর শোনার সুযোগ তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সত্ত্বেও, দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা ছিল।
দেশের জন্মের পঞ্চম দশকের মাঝামাঝি অর্থাৎ, ২০১০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে শুরু করে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা একে অপরকে শত্রু মনে করতে শুরু করেন। মতাদর্শগত বিরোধিতাকে অস্তিত্বের হুমকি হিসেবে দেখা শুরু হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে অনিষ্টকর মেরুকরণ এবং বিভেদ চর্চা শুরু হয়। সাংবিধানিক ও সংবিধান বহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্বল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দুর্বল করে দেয়া হয়।
এসব পরিস্থিতি বেসামরিক ছদ্মবেশে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় ফিরে আসার পথ প্রশস্ত করে। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলেও বাংলাদেশকে দেখতে হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের প্রাবল্য, এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ, বারবার কারচুপির নির্বাচন, বিরোধীদের অধিকতর নিপীড়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্থান সংকোচন এবং সুশীল সমাজ ও সংগঠনের বিনাশ।
ফলে সুবর্ণ জয়ন্তীর সময়ে জাতির অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাঙ্ক্ষিত যাত্রা হয়ে পড়েছে বিপরীতমুখী, বাড়ছে কর্তৃত্ববাদ।
আন্তর্জাতিক মনোযোগ
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম অবদানকারী দেশ হওয়া ছাড়া বৈশ্বিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভূমিকা দীর্ঘকাল সীমিত ছিল। স্বাধীনতার সময় এর বিদেশ নীতির প্রকাশ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠ মিত্রতার মধ্যে। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের আদর্শিক মনোভাব এবং সোভিয়েতের সহায়ক ভূমিকা ছিল এর মূল প্রভাবক। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন শুরুর পর বাংলাদেশ স্পষ্টত পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরায়। এই নীতি কয়েক দশক ধরে সামান্য ভিন্নতাসহ একই ধারায় রয়েছে।
গত দশকে বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের এক ধরনের আধিপত্যবাদী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
তবে ২০০০এর দশকে চীনের বৈশ্বিক মোড়ল হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন শুরু হলে, তাদের মনোযোগ বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দিকে পড়ে। ফলে বেইজিং ও নয়াদিল্লি বাংলাদেশে তাদের প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে।
যদিও ভারত সম্পর্কের দিক থেকে, বিশেষত: রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের বেশি কাছাকাছি থেকেছে, তবে বাংলাদেশ চীনের জন্য তার দরজা খুলে দিয়েছে এবং সম্পর্ক উষ্ণ হয়েছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের সাথে সাথে আগামী দিনে এই প্রতিযোগিতাগুলো আরও তীব্র হয়ে উঠবে।
দুই পথের মোহনায় বাংলাদেশ
৫০তম বছরে বাংলাদেশ এখন দুটি পথের মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি পথ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিহীন শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা, এভাবে চলতে থাকলে রাজনীতি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আরও সঙ্কুচিত হবে, অন্য পথ হচ্ছে এই গতিপথ বদলে গণতন্ত্রে ফিরে যাওয়া।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে গুটিকয়ের জন্য ক্রমাগত প্রবৃদ্ধির নীতিতে চলবে, নাকি বৈষম্য দূর করে সবার উন্নতির পন্থা অবলম্বন করবে সেই প্রশ্নের মুখোমুখি বাংলাদেশ।
আলী রীয়াজ একজন বাংলাদেশি-মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক, বর্তমানে ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর)। তিনি আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সভাপতি।
নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টিক কাউন্সিল, আমেরিকান ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ স্টাডিজ বা বেনারনিউজের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না, সম্পূর্ণ মতামত লেখকের নিজস্ব।
নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন পুলক ঘটক।