ভারত কেন হাসিনা সরকার চায়
2024.01.03
গত দুই মাসে ভারত একাধিকবার জানিয়েছে যে, আসন্ন সংসদ নির্বাচন একান্তই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচন বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ কিংবা আসন্ন ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত আহ্বানকে ভারত এখন পর্যন্ত পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।
“বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়, এবং আমরা বিশ্বাস করি নিজেদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে একমাত্র বাংলাদেশের জনগণই সিদ্ধান্ত নিতে পারে,” গত ২৯ ডিসেম্বর মন্তব্য করেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারকে অনেক বিশ্লেষক ‘প্রায় স্বৈরাচারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও এই মন্তব্যের ইঙ্গিত প্রায় পরিষ্কার যে, ২০০৯ সাল থেকে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলা শেখ হাসিনার পাশেই থাকছে ভারত।
ভারতের এই অবস্থানের অনুরণন রয়েছে বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণের মন্তব্যেও। বাংলাদেশে নির্বাচনের একটি নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে এবং অন্য কোনো দেশেরই এ বিষয়ে বিচারের অধিকার নেই বলে গত মাসে ঢাকা সফরের সময় মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন পঙ্কজ শরণ।
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা জানি যে প্রতিটি দেশের নিজস্ব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে। ...যথাসম্ভব সেরা নির্বাচন ব্যবস্থা রয়েছে। রয়েছে প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, এবং সবকিছু।”
“আমি মনে করি না, বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোনো দেশে নির্বাচন কীভাবে হবে সে বিষয়ে ভারতসহ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের কথা বলার কিছু আছে। ...না হলে একটি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কী মানে,” বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত।
তবে ভারতের এই সাবেক রাষ্ট্রদূত একটি বিষয় এড়িয়ে গেছেন, তা হলো, বিরোধীদলের বয়কট ও প্রতিবাদের মুখে টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনার ক্ষমতাগ্রহণের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিতব্য ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি হতে যাচ্ছে একটি নির্লজ্জ ও অগণতান্ত্রিক আয়োজন।
একই সাথে তিনি এটিও উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের এই নিজস্ব ‘পদ্ধতি’ ও ‘প্রক্রিয়া’ তৈরি হয়েছে গত কয়েক সপ্তায় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর কঠোর দমনপীড়ন, হাজার হাজার গ্রেপ্তার এবং দেড় হাজারের ওপর বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের কারাদণ্ড দেয়ার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে চীনের মজবুত ভিত
পঙ্কজ শরণের মন্তব্য থেকে ভারতের ক্ষমতাসীনদের অবস্থান প্রায় পরিষ্কার, যা ভারতীয় অনেক বিশ্লেষকের কথায়ও এর আগে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁরা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে সম্ভাব্য সব কিছু করার জন্য গত কয়েক মাস ধরে অব্যাহতভাবে ভারতের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন।
তাঁদের এই আহ্বানের পেছনে মোটাদাগে দুটি যুক্তি রয়েছে, প্রথমত ভারতের নিরাপত্তার বিষয় এবং দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব।
ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, সরকারবিরোধী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় এলে ইসলামি মৌলবাদের উত্থান ঘটবে এবং ভারতের অস্থিতিশীল উত্তরপূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে। (অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপির জয়লাভের বিষয়ে এখানে একটি অনুল্লেখিত স্বীকৃতি রয়েছে।)
তবে এটি বিস্ময়কর যে, ধর্মীয় ‘হিন্দুত্ববাদ’ আদর্শের রাজনীতি করা ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রতিবেশী বাংলাদেশে ধর্মঘেঁষা রাজনীতির সমর্থক নয়।
অন্যদিকে, চীনের সাথে বর্তমানে বাংলাদেশের সম্পর্ক পৌঁছে গেছে অনেক গভীর ও বিস্তৃত পরিসরে।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে (বিআরআই) বাংলাদেশ যোগ দেয় ২০১৬ সালে। বাংলাদেশের কাছে দুটো ডুবোজাহাজ বিক্রি করা ছাড়াও কুতুবদিয়াতে এক বিলিয়ন ডলারের সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ করছে চীন।
বড়ো ধরনের অনেক অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ এবং অব্যাহত অস্ত্র বিক্রি ছাড়াও বাংলাদেশে ৩৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন।
বাংলাদেশে চীনের এই ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির বিষয়টি ভারত অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোতে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি মোকাবেলায় সরাসরি উদ্যোগী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ এই উদ্যোগেরই অংশ।
যদিও ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের আশঙ্কা, গণতন্ত্র বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাংলাদেশেকে চীনের আরো ঘনিষ্ঠ করে তুলতে পারে।
ভারতের লক্ষ্য বাণিজ্য
চীনবিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক জোট কোয়াডের দুই সদস্য রাষ্ট্রের দুই মেরুতে অবস্থানের আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে? ব্যাখ্যার ইঙ্গিত রয়েছে ভারতের নিজস্ব উচ্চাভিলাষে।
প্রথমত, আঞ্চলিক পর্যায়ে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ভারতের উচ্চাভিলাষ রয়েছে।
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই দক্ষিণ এশিয়াকে ভারত অনেকটা নিজের বাড়ির উঠান হিসেবে গণ্য করে আঞ্চলিক দেশগুলোর ওপর অবাধ প্রভাব বিস্তার অব্যাহত রাখতে চায়। নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের ক্ষেত্রে গত কয়েক দশকে ভারতের নীতি দেশটির এই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।
দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন নেতৃত্ব মানতে রাজি নয় ভারত।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এক ভারতীয় বিশ্লেষক বলেন, “এটা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সহযোগিতার অলিখিত মূল শর্তের লঙ্ঘন, যা হলো, দিল্লির নিরাপত্তা ও দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা।”
ভারতের উদ্বেগের পেছনে দ্বিতীয় কারণ অর্থ ও বাণিজ্য।
গত দশকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশাল অগ্রাধিকার পেয়েছে ভারতের বাণিজ্য, বিশেষ করে যেগুলোর মালিকানায় রয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠজনেরা। এর একটি আদর্শ উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সেক্টরে আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ।
তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃহত্তম বিনিয়োগকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের সাথে ঢাকার সম্পর্ক উন্নয়ন আরো বেশি মার্কিন বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে পারে, যা ভারতের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে হবে প্রতিযোগিতামূলক।
বাংলাদেশ নিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক এই টানাপোড়েনে চীন, ভারত বা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হবে তা দেখার জন্য আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।
তবে এটি নিশ্চিত যে, ৭ জানুয়ারির পাতানো নির্বাচনের পর বাংলাদেশর বৈদেশিক সম্পর্কের ধরনে আসবে অনেক পরিবর্তন, নতুন মেরুকরণ।
..............................................
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর) এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো।
নিবন্ধের মতামত ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টিক কাউন্সিল বা বেনারনিউজের অবস্থানের প্রতিফলন নয়, লেখকের নিজস্ব।