বাংলাদেশের বিপ্লব: সমাপ্তির সূচনা, নাকি সূচনার সমাপ্তি?

মন্তব্য প্রতিবেদন: জন ড্যানিলোভিচ
2025.02.12
বাংলাদেশের বিপ্লব: সমাপ্তির সূচনা, নাকি সূচনার সমাপ্তি? ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবনের মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক ছবির মধ্যে একটি পারিবারিক ছবির দিকে তাকিয়ে আছেন এক তরুণ। বিক্ষোভকারীরা একদিন আগে ভবনটিতে লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
মেহেদী রানা/বেনারনিউজ

বাংলাদেশে ছয় মাস আগে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশ কিছু দিন তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। কিন্তু ৫ ফেব্রুয়ারি সামাজিক মাধ্যমে দেয়া ভাষণে তিনি আবারো উত্তেজনা ছড়ান। ভারতের কোনো এক অজ্ঞাত আশ্রয়স্থল থেকে প্রচারিত ভাষণে হাসিনা দাবি করেন, তাঁর নির্বাসনের পর সমঝোতার মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে "অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখলকারী।"

তাঁর এ বক্তব্য নৃশংস স্বৈরশাসন অবসানের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষুব্ধ করে। শেখ হাসিনা তাঁর সমর্থকদের প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিরোধের আহ্বান জানানোয় পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়।

বিক্ষোভকারীরা হাসিনার পিতা, দেশের স্বাধীনতার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ধ্বংস করে একটি বার্তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ভবনকে কেন্দ্র করে হাসিনা তাঁর শাসনামলে এক ধরনের ব্যক্তিপূজার পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।

সোশ্যাল মিডিয়া সাইট এক্স-এ আপলোড করা সংবাদ-ভিডিওতে হাসিনার বিতর্কিত ভাষণের ফুটেজ দেখানো হয়নি। বরং স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংসকে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয় বিক্ষোভকারীরা ভবনে আগুন লাগাচ্ছে ও দেয়ালে হাতুড়ি মারছে।

সম্ভবত হাসিনা ও তাঁর সমর্থকরা ছাত্রদের উসকে দেওয়ার মাধ্যমে তাঁদের কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়াই প্রত্যাশা করেছিলেন। বোঝাই যায় তাঁর দল আওয়ামী লীগ এ ঘটনাকে দেশে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্যের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্রদের এই ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেও বাস্তবতা হলো, ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে।

আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় যেমন বলেছি, হাসিনা যেভাবে ঘৃণার উদ্রেক করে চলেছেন তাতে এটা স্পষ্ট— তিনি চান, "কৃতজ্ঞতাহীন" এই বাংলাদেশ ধ্বংস হোক।

আর কিছু না হোক, গত সপ্তাহের ঘটনাগুলো হয়তো নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুততর করতে পারে— তা যেভাবেই হোক।

বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সক্রিয়। ফলে হাসিনার পতনের ছয় মাস পর ঘটে যাওয়া এই ঘটনাগুলো ক্ষমতার ভারসাম্যকে তাদের অনুকূলে ঠেলে দিতে পারে, যারা অর্থবহ সংস্কারের বদলে চিরাচরিত রাজনীতিই ফিরে পেতে চান।

hasina2.jpeg
ঢাকা’র যাত্রাবাড়ী এলাকায় সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীদের দিকে বন্দুক তাক করছে পুলিশ। ১৮ জুলাই ২০২৪। (মেহেদী রানা/বেনারনিউজ)

ভারতের সঙ্গে নতুন করে টানাপোড়েন

৫ ফেব্রুয়ারির ভাষণ ও পরবর্তী ঘটনাগুলো ঢাকাকে নয়া দিল্লির প্রতি আরও সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে, কারণ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে ভাষণ দিয়েছেন।

ঘটনাগুলো এমন একটা সময়ে ঘটল যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ভারতের একটি জাতীয় দৈনিকে উপ-সম্পাদকীয় লেখার মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছিলেন। এরপরেই শেখ হাসিনার বক্তব্য ও তার জের ধরে দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।

যদিও ঢাকা নয়াদিল্লির কাছে এই অ-বন্ধুসুলভ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছে, তবুও কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এড়াতে অন্যান্য মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করাও জরুরি।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুই প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৬-১৭ ফেব্রুয়ারি ওমানের মাসকাটে একটি সম্মেলনের ফাঁকে বৈঠক করতে পারেন।

hasina-yunus.jpeg
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট বিদেশ থেকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস। ছাত্রনেতাদের সুপারিশ অনুযায়ী তাঁকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়। (রয়টার্স)

আগাম নির্বাচনের দাবি

সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পর কিছু বিশ্লেষক ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ দ্রুত শেষ হতে চলেছে।

তাঁরা আশা করছেন, এই সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবেন।

ভারত, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি—সবাই আগাম নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, যদিও তাদের উদ্দেশ্য এক নয়।

অন্যদিকে, ছাত্ররাসহ কিছু রাজনৈতিক দল চাইছে আগে কিছু মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত করা হোক, তারপর নির্বাচন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও বরাবর বলে আসছেন, অন্তত ১২ থেকে ১৮ মাস পর নির্বাচন হওয়া উচিত, যাতে কিছু মৌলিক সংস্কার কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে।

আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকরা হয়তো মনে করছে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তাদের রাজনৈতিকভাবে লাভবান করবে, কারণ তারা এখন নিজেদের "ভুক্তভোগী" হিসেবে তুলে ধরতে পারবে।

কিন্তু শেখ হাসিনার ভাষণের পর উদ্ভূত আবেগ তাঁর বিরোধীদেরকে আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের নির্বাচনে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আরও সুদৃঢ় পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করছে বলে মনে হচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা, যিনি ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হয়, বলেছেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে অন্য সব দল একমত হয়েছে।

কেউ বিশ্বাস করে না, হাসিনা বা তার দল শীঘ্রই ক্ষমতায় ফিরে আসবে। তিনি ও তাঁর দলের সদস্যরা মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগের মুখোমুখি।

hasina-khaleda.jpeg
২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার সময় পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (বাঁয়ে) ও খালেদা জিয়া (ডানে)। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক পরিবার থেকে আসা এই দুই বৈরী নেতা আশির দশকের শেষ দিক থেকে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় একে অপরের সঙ্গে খুব কমই কথা বলেছেন। (এএফপি)

আওয়ামী লীগের এখন প্রধান লক্ষ্য ছাত্রদের কোণঠাসা করা এবং সংস্কারের পথ রুদ্ধ করা।

এজন্য দলটি সম্ভবত তার দীর্ঘকালীন বৈরি বিএনপির সঙ্গে অভিন্ন স্বার্থের সমঝোতা আশা করছে—যে দলটি পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

আওয়ামী লীগ হয়তো আশা করছে বিএনপি তার আগের চর্চায় ফিরে যাবে এবং দুটি প্রধান দলের মধ্যে বৈরিতা ঘুচে ফেলবে, যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার পথ সুগম হবে।

তবুও ইউনূস ও তাঁকে শক্তিযোগানো ছাত্ররা তাদের উল্লেখযোগ্য শক্তি কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য ম্যান্ডেট নিয়ে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

এই ঘনিয়ে আসা ঝড় বাংলাদেশের সকল গণতন্ত্রপন্থী শক্তিকে যেন মনে করিয়ে দেয়, বহিরাগত হুমকির মুখে জাতীয় ঐক্য এখন সময়ের প্রয়োজন।


জন ড্যানিলোভিচ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে অভিজ্ঞ। কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন; ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের উপপ্রধান। এখানে প্রকাশিত মতামত তাঁর নিজস্ব। এই লেখা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা বেনারনিউজের অবস্থানের প্রতিফলন নয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।