মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান: রোহিঙ্গাদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা

যাকারি আবুজা, মন্তব্য প্রতিবেদন
2021.02.05
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান: রোহিঙ্গাদের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে ব্যাংককে জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে অং সান সু চির ছবি হাতে মিয়ানমারের নাগরিকদের বিক্ষোভ। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[রয়টার্স]

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, তাতমাদো, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, বিষয়টি অনেকের কাছেই অদ্ভুত মনে হতে পারে। শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি কত আন্তরিকভাবেই না হেগ শহরের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা নিধন অভিযানের পক্ষে সাফাই গাইলেন!

তবে ২০২০ এর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চি'র রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল লিগ অফ ডেমোক্রেসি'র (এনএলডি) কাছে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক দল ‘ইউনিয়ন সলিডারিটি এন্ড ডেভলপমেন্ট পার্টি’র (ইউএসডিপি) বিপর্যয়কর পরাজয় বাহিনীটির জন্য কেবল অবমাননাকর নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল। এনএলডি সংসদের ৮৬ শতাংশ আসনে জিতেছে, আর ইউএসডিপি পেয়েছে ৫ শতাংশ আসন। 

মিয়ানমারের সংসদে সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও সু চির দল সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ৭৫ শতাংশ আসনের প্রায় কাছাকাছি পেয়েছে, যা সেনাবাহিনীর জন্য উদ্বেগের।

কারণ এতে সংবিধানে জুড়ে দেওয়া সেনাকর্তৃত্বের বিদঘুটে বিধানগুলো বাদ দিয়ে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অবসানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। 

সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে, বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার আগে তারা এক বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে। বাস্তবে অন্য কিছুও হতে পারে। থাইল্যান্ডে ২০১৪’র সেনা অভ্যুত্থানের পর যা হয়েছে আমরা সম্ভবত এক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতি দেখতে যাচ্ছি। কারণ জেনারেল মিন অং হ্লেইং স্পষ্টত একটি সংখ্যালঘু সরকারের কর্ণধার হয়ে বসেছেন। 

রোহিঙ্গাদের পক্ষে গণতন্ত্র কখনো আহামরি কোনো বিষয় ছিল না। সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিদ্বেষের বাণী প্রচারের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। নিগৃহীত সংখ্যালঘুকে রক্ষা করার পক্ষে সমর্থন ছিল না বললেই চলে। মনে রাখতে হবে যে সন্ত্রাসজনিত পরিস্থিতির কারণে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি অংশে নির্বাচন হয়নি। 

তাহলে রোহিঙ্গাদের জন্য তাতমাদোর অভ্যুত্থানে কী এসে যায়? 

বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। এ এক জটিল অবস্থা। সু চি'র বেসামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরার অনুমতি নাও দিতে পারত; নতুন পরিস্থিতির ফলে সহসাই তাঁদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা এখন আদতে অসম্ভব। 

প্রত্যাবাসন আলোচনা দীর্ঘায়িত করা হয়েছে এবং কয়েকটি নীতিগত চুক্তি হলেও সেগুলো কার্যকর হয়নি। প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দফা আলোচনা, একবার ২০১৮’র নভেম্বরে এবং আরেকবার ২০১৯ এর আগস্টে ভেঙে গেছে।

মিয়ানমারের দাবি অনুযায়ী ২০১৮ সাল থেকে ২০২০ সালের শেষতক মাত্র ৪৬০ জন শরণার্থী মিয়ানমারে ফিরেছে। যদিও বাংলাদেশ সরকারের মতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ ফিরলেও ফিরতে পারে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো একজন রোহিঙ্গাও ফিরে যায়নি।

এ অবস্থায় মিয়ানমার কেবল ৫৫০ জন হিন্দু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে বাংলাদেশ আশঙ্কা, এই প্রস্তাবে রাজি হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখানেই সমাপ্ত হয়ে যেতে পারে। 

মিয়ানমার সরকার সেখানে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বা আবাসিক অধিকার বা অন্যান্য আইনি সুরক্ষা দিতে রাজি নয়। ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে পাওয়া ছবিতে দেখা গেছে, সামরিক বাহিনী যে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো তছনছ করে দিয়েছিল, সেখানে এখন তারা ক্যাম্প তৈরি করছে। 

এনএলডি সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনকে ত্বরান্বিত করতে পারত এটা ভাবা বোকামি। কারণ চরম জাতীয়তাবাদী এনএলডি জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ জাতিগত বর্মীদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে। সেনাবাহিনীর মতোই গোষ্ঠী স্বার্থান্ধ বর্মীদের অধিকাংশই মনে করেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের আইনানুগ অধিকার নেই এবং তারা সেখানে অবৈধ বাঙালি অভিবাসী। তাঁদের এই চিন্তাধারা বদলের জন্য সু চি তেমন আগ্রহ দেখাননি। তিনি প্রকাশ্যেই নৃতাত্ত্বিক শুদ্ধি অভিযান এবং ব্যাপক ধর্ষণের প্রমাণসমূহ মুছে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। 

তাঁর সরকার ২০২০ সালের নভেম্বরে শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে কিছুটা আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। তবে তাঁর দল এনএলডি অন্যান্য সাংবিধানিক সংশোধনীকে অগ্রাধিকার দিলেও ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করার ব্যাপারে গড়িমসি করছিল।

২০২১’র জানুয়ারিতে তৃতীয় প্রত্যাবাসন সভা অনুষ্ঠিত হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ অভিযোগ করেছে মিয়ানমার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা যে গ্রামে বসবাস করত তাদের সেখানেই ফিরিয়ে নেবার আহ্বান মিয়ানমার প্রত্যাখ্যান করেছে।

সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই আলোচনা আবার কখন শুরু হবে বা হবে কিনা তা স্পষ্ট নয়। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ দীর্ঘ এক অচলাবস্থার কাছে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে এবং এক লক্ষ শরণার্থীকে ভাসানচরে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।

তাতমাদো মুষ্টিমেয় শরণার্থীকে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি অব্যাহত রাখতে পারে, তবে তাদের শিবিরে অবরুদ্ধ রাখা হবে। মিয়ানমার সরকারের দেওয়া জাতীয় যাচাইকরণ কার্ড রোহিঙ্গাদের “রাষ্ট্রহীন” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। যারা জাতীয় যাচাইকরণ কার্ড জমা দিচ্ছেন মিয়ানমার সরকার তাঁদের নতুন করে কার্ড দিচ্ছে। এই কার্ড তাঁদের নাগরিকত্ব অনুমোদনের পথ দেখাচ্ছে কিনা বা অন্যান্য আইনি সুরক্ষা দেয় কিনা তা স্পষ্ট নয়। 

শিবিরগুলিতে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের হতাশা শুধুই বাড়বে, যা আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি’র (আরসা) মতো জঙ্গিদের জন্য সর্বদা সুসংবাদ। হতাশ ঐ মানুষগুলো সশস্ত্র সংগঠনগুলোতে নাম লিখিয়ে সুরক্ষা পেতে চাইবে।

যদি জান্তা সরকার শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আরো অনাগ্রহী হয় তবে বাংলাদেশের কাছে তেমন কোনো বিকল্প নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমিত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আছে। জান্তা ইতিমধ্যে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন এবং বাইরের চাপের মুখে আছে। আর একটি মাত্র হাতিয়ার আছে- বাংলাদেশ যা এখন পর্যন্ত ব্যবহার করতে অনিচ্ছুক বলে মনে হচ্ছে। তা হলো, আরসার মতো সশস্ত্র দলগুলোকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অস্ত্র সরবরাহ, আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সজ্জিত করা। এটি বাংলাদেশের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর ফলে তাতমাদো প্রত্যাবাসন আলোচনা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারে। 

তাতমাদো তাদের ভাবমূর্তি উদ্ধার এবং কিছু আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আশায় প্রত্যাবাসন আলোচনা আবার শুরু করবে- এটা একেবারে অসম্ভব বলে মনে হয়। সিনিয়র সামরিক নেতৃত্ব তাদের অভ্যুত্থানের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়েই এগিয়েছে। এবং তারা এমন একটি সরকার যা মানবাধিকার রেকর্ড বা আন্তর্জাতিক সমালোচনায় কর্ণপাত করে না। তারা কেবল গণনায় নিয়েছে চীনের মতো দেশগুলোকে যারা তাদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে সহায়তা করবে এবং আসিয়ান তাদের চাপ দেবে না। 

সামরিক বাহিনী তাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বরং কদর্যভাবে মুসলিম বিরোধী মা বা থা এবং উইরাথুর মতো আরো কিছু গোঁড়া বৌদ্ধ ভিক্ষুর দিকে মুখ ফেরাতে পারে। সেনা-বিরোধী আন্দোলন উচ্চকিত হয়ে উঠলে অধিকাংশ বৌদ্ধ ধর্মযাজক জনসাধারণের পক্ষে থাকার সম্ভাবনা। তবে কট্টরপন্থী ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে এবং অন্যান্য মুসলিম ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য একে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য সরকারকে সমর্থন দিতে পারে। 

যাকারি আবুজা ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব এবং কোনোভাবেই তা ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স, ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারনিউজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।