খারকিভের প্রতিচিত্র: সমান্তরাল সংঘাতে মিয়ানমার ও ইউক্রেন
2022.03.17
ইউক্রেনে খুঁড়িয়ে চলা যুদ্ধে যখন রাশিয়ার বিজয়ের কোনো স্পষ্ট আভাস নেই, তখন আমরা মিয়ানমারের সংঘাতের সাথে এর গুরুত্বপূর্ণ সামঞ্জস্য দেখতে পাচ্ছি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ হোঁচট খেয়েছে। নির্বিচার বিমান হামলা এবং গোলন্দাজ বাহিনী নির্ভর আক্রমণে নির্ভুল নিশানায় যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োগ নেই। শহরগুলো দখল এবং ধরে রাখার জন্য পর্যাপ্ত বাহিনী রাশিয়ার নেই। তাই তারা নগরগুলো ঘিরে রাখছে এবং দূরপাল্লার আর্টিলারি ফায়ার করছে।
তারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিক, আবাসিক এলাকা এবং হাসপাতালগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মতো, রুশ বাহিনীও অবরোধ করেছে এবং মানবিক সহায়তা মিশনকে বেসামরিক মানুষের কাছে পৌঁছাতে বাধা দিয়েছে। এই বেসামরিক প্রাণক্ষয়কে অনিচ্ছাকৃত বলার সুযোগ নেই।
মিয়ানমার গোষ্ঠীর তথ্য অনুসারে, তাতমাদো নামে পরিচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গ্রামগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে। অন্তত ৬,৭০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে না পারায় তারা এ ধরনের শাস্তি দিচ্ছে।
স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে বিদ্রোহীদের আলাদা করতে মিয়ানমারের সামরিক শক্তি কয়েক দশক ধরে নির্মম “চতুর্মুখী বিচ্ছিন্নতার” কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু গত বছরের অভ্যুত্থানের পর থেকে ছায়া জাতীয় ঐক্য সরকারকে সমর্থন করা থেকে জনসাধারণকে নিবৃত করতে পারেনি।
রাশিয়া এবং মিয়ানমার উভয়ই অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণে গড়া নিচুমানের সেনাদের ওপর নির্ভর করে, যাদের মনোবল কম। রাশিয়ান বাহিনী মৃত্যু, আঘাত বা বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাই নেতারা চেচনিয়া, সিরিয়া এবং রাশিয়ার নিজস্ব আধাসামরিক সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপ থেকে ভাড়াটে সৈন্যদের জড়ো করছে।
মিয়ানমারের যেখানে তাতমাদোকে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে জান্তাপন্থী পিউ সও তি নামের স্থানীয় সামরিক শক্তির ওপর বেশি নির্ভরতা রয়েছে।
উভয় সরকারই ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার বাড়িয়েছে। রাশিয়া রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নয়, এমন মিডিয়ার ওপর প্রায় সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট আরোপ করেছে। বেশিরভাগ বিদেশি সাংবাদিকদের দেশটি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেছে। রাশিয়া তার ইন্টারনেটকে চীনা ধাঁচের ইন্টারনেটে রূপান্তরিত করছে।
মিয়ানমারে সরকারি নৃশংসতার প্রমাণ ঠেকাতে সাগাইংসহ সংঘাত-বিপর্যস্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভিন্নমত দমনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর পাহারা বসানো হয়েছে। উভয় দেশেই সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়ার দখলে থাকা শহরগুলোর মতই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বেসামরিক লোকদের হত্যা করছে।
উভয় দেশের নেতৃত্ব বিশ্বাস করে, যদি তারা যথেষ্ট সহিংসতার সাথে কাজ করে তবে তারা বেসামরিক জনগণকে তাদের ইচ্ছামতো চালাতে পারবে এবং নিজেদের সমস্ত দায়বদ্ধতা এড়াতে সক্ষম হবে। মিয়ানমারে সাম্প্রতিক লড়াইয়ে পাঁচ ডজনেরও বেশি বেসামরিক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। উভয় সরকারই তাদের যুদ্ধাপরাধ আড়াল করার চেষ্টা করে না; আসলে তারা এসব দেখিয়ে জনসাধারণকে তাদের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করতে চায়।
তাদের সাধারণ বিশ্বাস হলো, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারে এবং উভয় সরকারই তাদের জনগণের অর্থনৈতিক সংকটের প্রতি কঠোর অবহেলা প্রদর্শন করছে। উভয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এক দশক ধরে দ্রুত বিপরীতগামী।
মিয়ানমারের জান্তা ২০২১ সালে দেশটির অর্থনীতিকে ১৮ শতাংশ সংকোচনের কবলে পড়তে দেখেছে এবং অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা এখন দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে। উভয় দেশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় আছে এবং তাদের বৈদেশিক বাণিজ্য অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। আজ ইয়াঙ্গুনের নাগরিকরা বৈদ্যুতিক ঘাটতি এবং পানির সংকটে আছেন।
অবিশ্বাস্য সাহস
উভয় দেশের যুদ্ধে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য সাহস দেখা যাচ্ছে। আমরা ইউক্রেনে আত্মরক্ষায় দুঃসাহসীভাবে লড়তে দেখেছি। পাশাপাশি মিয়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এবং তাদের সহযোগী এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশনের (ইএও) বীরত্বপূর্ণ লড়াই দেখেছি। তারা অদম্য প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মতো স্থানীয় দুর্নীতির কারণে তাতমাদো’র পেছনে যে পরিমাণ টাকা ঢালা হচ্ছে, তার তুলনায় বাহিনীটি অস্ত্রশস্ত্রে এবং কার্যকরতায় দুর্বল। কর্তৃত্ববাদ নিরাপত্তা পরিষেবাসহ বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দেয়।
পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) এর তহবিল সংগ্রহ, অস্ত্র ও গোলাবারুদ অর্জনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সম্প্রতি আমরা বেশ কয়েকটি যুদ্ধ দেখেছি যাতে প্রায় ডজনখানেক পিডিএফ কর্মী গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে নিহত হয়েছেন। এনইউজে ঘোষণা করেছে যে, তাদের পিডিএফে এই বছর ৩ কোটি ডলার বাজেট থাকবে।
যদিও আধা রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে এই পরিমাণ তহবিল উল্লেখযোগ্য, তবে তাতমাদোর তুলনায় এটি নগণ্য। কেবলমাত্র উপাদানে তাদের অপ্রতিসম আধিপত্যের মাধ্যমে, রাশিয়ান সামরিক বাহিনী এবং তাতমাদো একটি দীর্ঘ যুদ্ধকে পিষে ফেলতে সক্ষম।
ইউক্রেনীয় বাহিনীর মতো মিয়ানমারের পিডিএফ এবং তাদের অনুমোদিত ইএওগুলোর উচ্চ মনোবল, শৃঙ্খলা এবং ন্যায়যুদ্ধের প্রেরণা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধ না করার চেষ্টা, ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু না বানানো বা লুটপাট ও চুরি না করার ক্ষেত্রে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের উচ্চ মান ধরে রাখছে। তাতমাদো বা রাশিয়ানদের বিপরীতে, তাদের জনপ্রিয়তা অপ্রতিরোধ্য।
একটি বিষয় হলো, পিডিএফ এবং ইএওগুলি তাতমাদোর দীর্ঘমেয়াদী দুর্বল সরবরাহ লাইনগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর দিকে সেভাবে মনোযোগ দেয়নি। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী একসঙ্গে এতগুলো ফ্রন্টে কখনোই যুদ্ধ করেনি এবং তাদের কখনোই জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মার জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরে যুদ্ধ করতে হয়নি।
ইউক্রেনীয়রা এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে অনেক বেশি মাত্রায়। সামরিক বাহিনীর বিমান জ্বালানিকে লক্ষ্য বস্তু বানানো সর্বোত্তম উপায়।
দখলদার বাহিনীকে পরাস্ত করতে ও তাদের বর্বর আক্রমণ এবং জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পিডিএফগুলো প্রশংসনীয় কাজ করছে।
উভয় ক্ষেত্রেই যুদ্ধ শেষ হতে পারে ভেতর থেকে। রাশিয়ার ব্যবসায়ী নেতৃত্ব বা অলিগার্চরা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে নাও দাঁড়াতে পারে। কারণ তারা কোনো জবরদস্তিমূলক উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করে না। পুতিন যে হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন তা তার নিজস্ব নিরাপত্তা পরিমণ্ডল থেকে। তিনি সেনাবাহিনীর দুর্বল কর্মক্ষমতার জন্য বলির পাঁঠা হবেন বলে মনে হচ্ছে।
মিয়ানমারে জান্তা নেতা মিন অং হ্লাইং এবং তাঁর সহযোগী সোয়ে উইনের জন্য আসল হুমকি এসেছে নিম্নপদস্থ জেনারেল এবং কর্নেলদের কাছ থেকে, যারা সামরিক শাসনের লুণ্ঠনে অংশ নেননি। এরা তারাই যাদের যুদ্ধটা বাস্তবে চালাতে হয় এবং হতাহতের হার এবং দলত্যাগের হার দেখে যারা বুঝতে পারে যে তাদের অঞ্চল ধরে রাখার মতো জনবল নেই। এই লোকগুলো জানে সামরিক বাহিনী কতটা ঘৃণ্য এবং এর শাসনের বৈধতা আদৌ নেই।
তারা সেই লোক, যারা জানে যে যুদ্ধটি অজেয় এবং সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ হাসিলের পর যা অবশিষ্ট আছে সেগুলো রক্ষায় তাদের আগ্রহ রয়েছে। তারা জানে যে শুধুমাত্র আলোচনার মাধ্যমে এই সংকট নিষ্পত্তি হতে পারে, যা এখনও এই সিনিয়র নেতৃত্বের দ্বারা অসম্ভব।
যাকারি আবুজা ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ ও জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এই নিবন্ধের মতামত লেখকের নিজস্ব এবং কোনোভাবেই তা ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স, ন্যাশনাল ওয়ার কলেজ, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় বা বেনারনিউজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়।