ট্রাম্পের 'সহায়তা স্থগিত' করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মার্কিন কর্মসূচি ঢেলে সাজানোর সুযোগ

জন ড্যানিলোভিচের বিশ্লেষণ
2025.02.03
ট্রাম্পের 'সহায়তা স্থগিত' করার  সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মার্কিন কর্মসূচি ঢেলে সাজানোর সুযোগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)’র কয়েকটি কর্মসূচি-সম্পর্কিত পৃষ্ঠার স্ক্রিনশট। ট্রাম্প প্রশাসন ২০ জানুয়ারি বিদেশি সাহায্য ৯০ দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার পরও গত গত ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এগুলো সরানো হয়নি। ছবি শেয়ারিং ওয়েবসাইট ফ্লিকারে ইউএসএআইডি বাংলাদেশের যেসব কর্মসূচিতে অর্থায়ন করেছিল তার কিছু নমুনা দেখানো হয়েছে।
(ফ্লিকারের মাধ্যমে ইউএসএআইডি বাংলাদেশ)

ট্রাম্প প্রশাসন গত ২০ জানুয়ারি সব ধরনের মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রচারণা চক্র মজা নিচ্ছিল।

এই চক্রের সঙ্গে ভারতের অনেক ডানপন্থী মিডিয়া ভাষ্যকার যুক্ত, যারা নয়াদিল্লির ইঙ্গিতে কাজ করে। তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে শুরু করে, ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অসন্তোষের ইঙ্গিত।

কিন্তু শিগগিরই তাদের মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়— যখন বুঝতে পারে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত "মার্কিন বৈদেশিক সহায়তা শিল্প" থেকে বাদ পড়েছে।

এমনকি ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা পেত এবং দেশটির এনজিওগুলোর জন্যও এই সহায়তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যখন এক্স -এ বিষয়টি তুলে ধরি, তখন ভারতের অতি-জাতীয়তাবাদী ভাষ্যকাররা কয়েকদিন ধরে একে "ভুয়া খবর" বলে তীব্র উপহাস করতে থাকে।

সে যাই হোক, বাংলাদেশে উন্নয়ন সহায়তা বন্ধের বাস্তব প্রভাবকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই, বিশেষ করে যখন দেশটি কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সুবিধাভোগী এবং সহায়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর এর প্রভাব পড়বে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার অনুমতি দেওয়া হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি)’র অর্থায়নে পরিচালিত স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন ও শিক্ষা খাতের অনেক কর্মসূচি কঠিন সংকটের মুখে পড়েছে।

স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে একটি স্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থার ১,০০০-এর বেশি কর্মী চাকরি হারিয়েছেন, কারণ তারা ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন।

 

6768e5fe-888d-40b0-bb20-3f759e06c864.jpeg
ঢাকার ধামরাইয়ে অবস্থিত স্নোটেক্স গ্রুপের একটি কারখানায় পোশাক শ্রমিকরা সেলাইয়ের কাজ করছেন। ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪। (মুনির উজ জামান/এএফপি)

 

বিশ্বব্যাপী সহায়তা কর্মসূচিগুলোকে নতুন মার্কিন নীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত আকস্মিক কিছু নয়। কারণ নির্বাচনী প্রচারের সময় এ নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছিল।

প্রান্তিক স্তরে এই সহায়তা বন্ধের বাস্তব প্রভাব পড়লেও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ককে শুধুমাত্র সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ভাবা যুগোপযোগী হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি, আমেরিকায় বসবাসকারী নাগরিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স এবং বিশ্বব্যাংকের মতো মার্কিন-প্রভাবিত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দেয়া ঋণ —এসবই দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কতটা প্রতিযোগিতামূলক থাকবে। কারণ এটি শুল্ক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

এছাড়া, অভিবাসন সীমিত করা এবং অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো হলে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে পারে। এর ওপর যদি যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি কর্মীদের পাঠানো অর্থের ওপর কর বসানো হয়, তাহলে রেমিট্যান্স আরও কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

 

dc8bb0fd-fe85-495e-9ac3-2ded0fe3ebc5.jpeg
ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াড জোটের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা (বাম থেকে ডান) জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইওয়া তাকেশি, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওয়ং ২১ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে বৈঠক করেন। এর একদিন আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। (এলিজাবেথ ফ্রান্টজ/রয়টার্স)

 

সহায়তা স্থগিতের ৯০ দিন পর কী হবে তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতে পারছে না। এমনকি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে ইউএসএআইডি টিকে থাকবে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বৈদেশিক সহায়তা নীতি নির্ধারণের এই সময়টাতে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে বোঝা ভাগাভাগি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের আলোচনা করা উচিত। বিশেষ করে কোয়াড জোটের দেশ— ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে এই আলোচনা জরুরি।

ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ অবস্থিত হওয়ায় কোয়াড সদস্যদের উচিত ঢাকার জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা আরও বাড়ানো, যাতে চীনের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।

এতে জাপানের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কমে যাওয়া দ্বিপাক্ষিক সহায়তার ঘাটতি পূরণেও সহায়ক হতে পারে।

অনেক বিশ্লেষক যখন ঢাকা-ওয়াশিংটনের সহায়তা স্থগিত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তখন দুই দেশের সম্প্রসারিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাদের চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে।

প্রথমত, ২৪ জানুয়ারি একটি মার্কিন কোম্পানি বাংলাদেশের সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার নতুন চুক্তি করেছে।

দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত স্থান।

 

044c2b49-3f83-44e2-9be9-cea339f33a6a.jpeg
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের ২২ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ৫৫তম বার্ষিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) সম্মেলনে অংশ নেন। (ইভস হারম্যান/রয়টার্স)

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত আগস্টে পালানোর পর যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল , তার পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সম্পর্কে সতর্ক ছিলেন।

কিন্তু সাম্প্রতিক বিনিয়োগের আগ্রহে বোঝা যায়, বাংলাদেশে ব্যবসা ও রাজনীতির পরিবেশ ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাণিজ্য বাড়ানো ও মার্কিন বিনিয়োগ আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে।

এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। যেমন গত মাসে দাভোসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে অংশগ্রহণ করেছেন, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক।

অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সহায়তার চেয়ে বাণিজ্যই প্রকৃত উন্নয়ন আনে। তাই বিদেশি সাহায্যের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করা সঠিক পথ নয় এবং এটি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

সহায়তা স্থগিতের ৯০ দিনের ধোঁয়াশা কেটে গেলে বাংলাদেশের জন্য মার্কিন বিনিয়োগ কোন খাতে আসবে তা সামগ্রিক নগদ ডলারের পরিমাণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে।

গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সহায়তা কর্মসূচি একটি ভিন্ন সময়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের এগুলো পর্যালোচনা করা বাংলাদেশের জন্য হয়তো ভালোই হবে।

সব কর্মসূচি ওলটপালট করা অবশ্যই জরুরি নয়, তবে আগের মতোই সব রেখে দেওয়ার জন্য চাপাচাপি ভুল হতে পারে।

 

গণতন্ত্রের জন্য অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দিন

উদাহরণস্বরূপ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রকল্পগুলোতে অর্থায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেক বেশি উপকারী হতে পারে।

তেমনি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ঘটনাগুলো দেখে বাংলাদেশের প্রযুক্তি মনস্ক (Gen Z) তরুণদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দিলে সম্ভবত বেশি লাভ হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থীরা হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন এবং সারাদেশে ছড়িয়ে দেন তাদের মধ্যে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিপক্কতা ছিল।

এ ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের তরুণদের ক্ষমতা কাজে লাগানো কতটা জরুরি।

তাদের প্রয়োজন বুঝে কর্মসূচি তৈরি করা উচিত, যাতে তারা বাংলাদেশ, এশিয়া তথা পৃথিবীজুড়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে । এটি হবে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন।

 

লেখক পরিচিতি:

জন ড্যানিলোভিচ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে অভিজ্ঞ। কূটনৈতিক কর্মজীবনে তিনি ঢাকায় তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন; ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসের উপপ্রধান। এখানে প্রকাশিত মতামত তার নিজস্ব। এই লেখা মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর বা বেনারনিউজের অবস্থানের প্রতিফলন নয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।