আসামে বাংলাদেশি হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের নাগরকিত্ব প্রদানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

বেনার নিউজ স্টাফ
2016.10.18
Share on WhatsApp
Share on WhatsApp
161018-IN-assam-620.jpg আসামে বাংলাদেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব প্রদান সংক্রান্ত বিল দ্য সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০১৬ এর বিরুদ্ধে ‘অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের’ অবস্থান। অক্টোবর ১৮, ২০১৬।
ঝুমুর দেব/বেনার নিউজ

আসামে বাংলাদেশি হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের নাগরকিত্ব প্রদানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের ২৫টিরও বেশি জাতিভিত্তিক সংগঠন। সারা প্রদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে গতকাল মঙ্গলবার থেকে তারা প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করছেন।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) যে দ্য সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০১৬ প্রণয়ন করেছে, তা ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির বিরোধী। ওই চুক্তিতে ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা মুসলিম যে কেউ আসামে প্রবেশ করলে তা অবৈধ হবে।

আসামের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৬৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১৪৪ কিলোমিটার ও নদী আছে ১১৯ কিলোমিটার।

আসাম গণপরিষদ (এজিপি) একটি অভিবাসী বিরোধী সংগঠন। এই সংগঠনের নেতা অতুল বোরা বেনার নিউজকে বলেন, “প্রত্যেক বাংলাদেশীকে আসাম ছাড়তে হবে। আসাম চুক্তিতে বলা হয়েছে, যে কেউ অবৈধভাবে আসামে প্রবেশ করলে তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এ ক্ষেত্রে কোন বাছবিচারের সুযোগ নেই। ”

নতুন এই বিলটি আগামী মাসে সংসদে বিতর্কের জন্য উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। নতুন এই বিলে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নির্যাতিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্বের বিধান রাখা হয়েছে।

বোরা বলেন, “বিলটি পাস হলে আসামে অবস্থানকারী দেড় লাখ বাংলাদেশি হিন্দু নাগরিকত্ব পাবেন। আরো অনেকে দালিলিক প্রমাণ ছাড়াই হাজির হবেন। এতে করে অসমিয়ারা চাকরি হারাবেন। বাংলা ভাষাভাষী অভিবাসীদের সংস্কৃতির তোপে অসমিয়াদের সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে।”

আশির দশকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশ বিরোধী যে সহিংস ছাত্র আন্দোলনে দুই হাজার দুশোর মত মানুষ খুন হয়েছিলেন, বোরার এজিপি মূলত ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে গঠিত।

ওই সহিংস আন্দোলনের ফলে আসাম সরকার ছাত্রদের সঙ্গে আসাম চুক্তি করতে বাধ্য হয়। প্রভাবশালী ওই ছাত্র সংগঠনটির নাম ছিল অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ)।

এএসিইউ এর একজন নেতা বলছেন, নতুন এই প্রতিবাদ কর্মসূচির উদ্দেশ্য সরকারকে এই নাগরিকত্ব (সংশোধন) বিল থেকে সরিয়ে আনা।

ইউনিয়নের নেতা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বেনার নিউজকে বলেন “দেশভাগের সময় এবং এরপরেও বহু শরণার্থী আসামে এসেছেন। আসাম এমনিতেই শরণার্থীদের ভারে ন্যুব্জ। এই প্রদেশ অবৈধ বাংলাদেশিদের ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না।”

বিভক্ত শাসন করা নীতি

বিজেপির প্রধান বিরোধী দল দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস আসামের ডাকা আন্দোলনে শরিক হওয়ার হুমকি দিয়েছে।

আসামের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা তরুণ গগই বলেন, “মোদী বলছেন হিন্দুরা বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাই তিনি তাদের আশ্রয় দিতে চান। আমরা শক্তভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করব।”

অন্যদিকে মুসলিম নেতারা বলেন, বিজেপি বিভক্ত ও শাসন করার নীতিতে বিশ্বাসী বলেই শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাগরকিত্ব দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে, মুসলিমদের নয়।

নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে, এমন একটি বেসরকারী সংস্থা চর চাপরির সভাপতি হাফিজ আহমেদ বেনার নিউজকে বলেন, “বিজেপি একটি সাম্প্রদায়িক দল। তারা সবসময় ধর্মকে পুঁজি করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ঘৃণ্য চেষ্টা চালায়। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে আসা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব দিয়ে আসলে বিজেপি তাদের সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়।”

নিখিল ভারত বাঙ্গালী উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতি ও আসাম শাখার সভাপতি সহদেব দাস এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। এই সংগঠনটি অভিবাসী বাংলাদেশি হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে।

“বাংলাদেশে হিন্দুরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন, তাদের আর সে দেশে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। এটা অসম্ভব। আমরা বছরের পর বছর দাবি জানিয়ে আসছি বাঙ্গালী হিন্দু অভিবাসীদের শুধু শরণার্থী মর্যাদা নয়, নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। দালিলিক প্রমাণ ছাড়া বাঙ্গালী শরণার্থীদের থাকতে দিয়ে এই দাবির অর্ধেকটা পূরণ হয়েছিল”, দাস বলেন।

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ সালের মধ্যে যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী বৈধ কাগজপত্র নিয়ে আসামে এসেছেন তাদের অনির্দিষ্ট কালের জন্য সরকার ভারতে থেকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। দাস মূলত এই প্রসঙ্গটির কথাই উল্লেখ করেছেন।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আদি গৃহ

অন্যদিকে বিজেপি বলছে, নতুন এই বিলটি পাস হলে আসাম একটি মুসলিম প্রধান রাজ্যে পরিণত হওয়ার আশংকা থাকবে না।

বিজেপির মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী হিমান্ত শর্মা বেনার নিউজকে বলেন, “ভারত নির্যাতিত হিন্দুদের আদি গৃহ। তারা কোথায় যাবে? হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিলে আসাম যে মুসলিম প্রধান রাজ্য হওয়ার পথে হাঁটছে সেই আশংকা দূর হবে।”

আসামের গভর্নর ১৯৯৮ সালে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। ওই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আসামে মুসলিমদের হার ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। যেখানে সারা দেশে এই বৃদ্ধির হার ৫৫ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দেয় সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা বিজেপির এই উদ্যোগকে ভবিষ্যতে তাদের ভোট বাড়ানোর কৌশল বলে বিবেচনা করছেন।

নির্বাচনোত্তর একটি জরিপ বলছে, বিজেপি আসাম থেকে ৬৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে শুধু তাদের মুসলিম বিরোধী অবস্থানের কারণে। নির্বাচন কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক সংগঠন সিভোটার ওই জরিপটি করে। সেখানে বলা হয়েছে, আসামে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ৭০ শতাংশ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে।

গুয়াহাটি ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনিরুল হুসেইন বেনারকে বলেন, “বিজেপি সরকার যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে চাচ্ছে নতুন এই বিলটিতে তা স্পষ্ট। এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে দলটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হাতে রাখতে চায়।”

মনির আরো বলেন, “মোদীর বোঝা উচিৎ আসামে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে মানুষের অবস্থান অত্যন্ত জোরালো। সব বাংলাদেশিকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে তিনি নির্বাচনে ভোট পেয়েছেন।”

তাঁর মতে, এখন আসাম চুক্তি ভেঙে তিনি যদি বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেন, তাহলে আসামে ঠিক যেভাবে যে গতিতে ভোট পেয়েছিলেন, জাতিভিত্তিক দলগুলোর কাছ থেকে একইভাবে একই গতিতে সমর্থন হারাবেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।