মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে বিজিবির সংঘর্ষ
2015.08.26
বুধবার বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মিয়ানমারের একটি ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ দলের গোলাগুলির পর সেখানে যৌথ অভিযান চালিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও সেনাবাহিনী। এ ঘটনায় একজন বিজিবি সদস্য আহত হয়েছেন।
‘রোহিঙ্গা’ এবং সম্প্রতি ‘নায়েক রাজ্জাক’ ইস্যুতে কয়েকমাস ধরে দুদেশের মধ্যে শীতল সম্পর্ক গেলেও এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই গোলাগুলির ঘটনায় দেশটির সামরিক বাহিনী বা মায়ানমারে সরকারের কোন সমর্থন আছে, এমন খবরও এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এদিকে আহত বিজিবির নায়েক মো. জাকিরকে হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রাম সিএমএইচ-এ নেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষকালে তার হাতে গুলি লেগেছে। বর্তমানে তিনি আশঙ্কামুক্ত এবং ভাল আছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
সন্ত্রাসীদের দমনে যৌথ অভিযান চলবে
বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনার জন্য দূর্গম ওই এলাকায় হেলিকপ্টারে করে বিজিবি ও সেনা সদস্য পাঠানো হয়। যৌথ অভিযানের পর বিকালে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পিছু হটে গেছে। পরিস্থিতি এখন শান্ত। ওই এলাকায় বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান চলবে”।
বিজিবি মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে আরো জানান, মিয়ানমারের সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে তাদের সীমান্ত ‘বন্ধ করে দিতে’ অনুরোধ জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তও ঘিরে রাখা হয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে কঠোর। মিয়ানমার তাদের দমনে সব ধরনের সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “মিয়ানমারের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে দমনের জন্য যে ধরনের অপারেশন দরকার, তা চালানো হবে। সেটা কমবিং (চিরুনি) অপারেশন বা যৌথ অভিযানও হতে পারে; যাতে তারা ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটাতে পারে।”
মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী ওই দলটির নাম ‘আরাকান আর্মি’ বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।
নেপথ্যের কারণ
ঘটনার কারণ বর্ণনায় বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “মঙ্গলবার বিজিবি সদস্যরা আরাকান আর্মির মালামাল বহনের কাজে ব্যবহৃত বিশালাকৃতির ১০টি ঘোড়া আটক করে। ধারণা করা হচ্ছে তারই জের ধরে বুধবার সকালে তারা এই হামলা চালিয়েছে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং গুলি বিনিময় ঘটেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গেই। তাই কোনভাবেই এটাকে দুদেশের মধ্যকার সংঘর্ষ বলা যাবে না।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে আক্রমণকারীদের সমর্থনে কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং তাদের বিষয়ে দেশটির কঠোর মনোভাব জানা গেছে। সুতরাং বলাই যায় এটা একটি দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আক্রমণ। তবে তারা কারা সেটা এখনই বলা যাবে না। দেশটির এই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীর উপস্থিতি মিয়ানমারও জানে। সুতরাং আশা করা যায়, এই সংঘর্ষকারীদের দমনে দেশটিও আন্তরিকতার পরিচয় দেবে।”
বিজিবি জানায়, বান্দরবনের মদক এবং পার্শ্ববর্তি বাতংপাড়ায় নিয়োজিত বিজিবি’র একটি টহল দলের উপর মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠি অতর্কিত আক্রমণ করে। এ সময় বিজিবি সদস্যরা সন্ত্রাসীদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। এভাবে প্রায় ৫ ঘন্টা থেমে থেমে গুলি বিনিময় হয়।
পরে আক্রান্ত বিজিবি দলের শক্তি বাড়াতে হেলিকপ্টারে করে ২টি সেনা ও ১টি বিজিবি টহল এবং পার্শ্ববর্তী সেনা ক্যাম্প হতে আরও একটি টহল ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়।
এছাড়া বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিমান ওই এলাকায় প্রদক্ষিণ এবং বিজিবি টহলদল পাল্টা আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিলে সন্ত্রাসীরা ওই এলাকা ত্যাগ করে। এরপর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আহত নায়েক জাকিরকে হেলিকপ্টারযোগে মদক বিওপি হতে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
দ্বিপক্ষীয় সর্ম্পন্নোয়নে সাড়া
এদিকে দীর্ঘদিন ধরেই দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের মাধ্যমে নিরাপত্তা, গ্যাস, বিদ্যুৎ আমদানির মত নানা বিষয়ে চুক্তিতে পৌঁছাতে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে দু’দেশের মধ্যে কয়েকটি সরকারি সফর বিনিময় হওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গা এবং বিজিবি’র নায়েক রাজ্জাক ইস্যু সামনে আসায় পিছিয়ে যায় সবকিছুই।
উল্লেখ্য গত ১৭ জুন টেকনাফের নাফ নদীতে বিজিবির একটি দল টহল দেয়ার সময় মিয়ানমারের বর্ডার গার্ডের সদস্যরা নায়েক রাজ্জাককে ধরে নিয়ে যায়। এনিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। পরে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পর ২৫ জুন তাকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে।
বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও সাড়া মিলছিল না প্রতিবেশী দেশটির। তবে কয়েকদিন হল বাংলাদেশের পাঠানো নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তির খসড়ার প্রতিউত্তর দিয়েছে মিয়ানমার। দীর্ঘদিন পরে হলেও তাদের সাড়ায় বেশ খুশি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের মহাপরিচালক আসুদ আহমেদ বেনারকে বলেন, “মিয়ানমারের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির জন্য একটি খসড়া পাঠানো হলেও তাদের সাড়া মিলছিল না। তবে প্রায় সাত মাস পরে গত সপ্তাহে তারা জবাব দিয়েছে। আমাদের প্রস্তাবিত খসড়ায় তারা খুব বেশি পরিবর্তনও চায়নি। যেটুকু চেয়েছে তা আমাদের পক্ষে মানা কঠিন নয়। দেশটির এ ধরনের ইতিবাচক মনোভাবই আমরা দীর্ঘদিন থেকে আশা করে আসছি।”