অভিনব কায়দায় এটিএম বুথ থেকে টাকা চুরি

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.11.21
ঢাকা
191121_ATM_Fraud-Bangla_620.JPG কুমিল্লায় পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন অজ্ঞাত পরিচয় এই দুই ব্যক্তি। এই দুজনের কাউকে চিনতে পারলে জানাতে অনুরোধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ১৭ নভেম্বর ২০১৯।
[সৌজন্যে: ডিএমপি নিউজ]

এটিএম বুথ থেকে অভিনব কায়দায় প্রায় নয় লাখ টাকা চুরির ব্যাপারে পুলিশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেছে পূবালী ব্যাংক। ভিডিওচিত্র থেকে পুলিশ ইতিমধ্যে নিশ্চিত হয়েছে যে, একই চক্র তিনটি চুরির ঘটনায় জড়িত।

জালিয়াতদের ছবি ও ভিডিওসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র দিয়ে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা পুলিশের কাছে তিনটি পৃথক মামলা করা হয়েছে বলে বেনারকে জানান পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়। এ বছর জুন মাসে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এটিএম মেশিন থেকে টাকা চুরির সময় ধরা পড়ে ইউক্রেনের ছয় নাগরিক।

ওই ঘটনার কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন ব্যবস্থার নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের অনলাইন আর্থিক ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে। আর এই সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি জালিয়াত চক্র।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল হালিম চৌধুরী বেনারকে বলেন, “গত রোববার রাতে আমাদের ব্যাংকের চট্টগ্রাম কলেজ রোড শাখা ও শেখ মুজিব রোডের দুটি বুথ এবং কুমিল্লা কান্দিরপাড় বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় নয় লাখ টাকা চুরি গেছে।”

এর মধ্যে ছয় লাখ টাকা চট্টগ্রাম থেকে আর প্রায় তিন লাখ টাকা কুমিল্লা থেকে খোয়া গেছে বলে তিনি জানান।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, “বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক থেকেই টাকা চুরি করেছে হ্যাকাররা। কিন্তু অন্য ব্যাংকগুলো গোপন করেছে। আমরা গোপন করিনি।”

তিনি বলেন, “আমরা এটিএম মেশিন জালিয়াতি করে টাকা চুরির বিষয়ে আজ চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় পৃথক তিনটি মামলা করেছি। আমরা চোরদের ছবিসহ সকল তথ্য পুলিশকে সরবরাহ করেছি।”

আব্দুল হালিম বলেন, “টাকা চুরি করার উদ্দেশ্যে দেশের ভিতর বাইরে থেকে সব সময়ই সাইবার অ্যাটাক হয়। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্ত বলে এত দিন কিছু করতে পারেনি। তবে, এবার করেছে। নিশ্চয়ই কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল বলেই করতে পেরেছে।”

তিনি বলেন, “তারা মেশিনের সামনের অংশ খুলে ভেতরে চিপ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে টাকা নিয়ে গেছে। আমরা ইতিমধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি যাতে আর টাকা চুরি করতে না পারে।”

ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি শাহিদুর রহমান বেনারকে বলেন, “এর আগে ইউক্রেনীয় হ্যাকাররা এটিএম বুথের সাথে থাকা সেন্ট্রাল সার্ভারের যোগাযোগ কেটে দিয়ে মেশিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টাকা চুরি করে।”

“এবার পূবালী ব্যাংকের এটিএম মেশিন থেকে টাকা চুরির ক্ষেত্রে তারা মেশিন খুলে সেখানে একটি ইউএসবি ডিভাইস অথবা পেনড্রাইভ ঢুকিয়ে এটিএম মেশিনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে থাকা সব টাকা নিয়ে গেছে”, যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, এই চুরিতে কোনো গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা চুরি যায়নি। এটিএম মেশিনগুলোতে যত টাকা ছিল সমুদয় টাকা তারা নিয়ে গেছে।

শাহিদুর রহমান বলেন, “বিষয়টি পুলিশের চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কর্মকর্তারা তদন্ত করছেন। আমাদের কাছে তারা সাহায্য চেয়েছেন।”

ঢাকা মহানগর পুলিশের অনলাইন নিউজ পোর্টালে ১৯ নভেম্বর ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, “ছবিতে প্রদর্শিত ব্যক্তিদ্বয়কে খুঁজছে পুলিশ। ঘটনার রহস্য উদঘাটনের স্বার্থে এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই সকল অপরাধীদের পরিচয় জানা আবশ্যক।”

ব্যক্তিদ্বয়ের নাম, ঠিকানা ও পেশা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকলে পুলিশকে তা অবহিত করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। অনলাইন সেবা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অধিকাংশ ব্যাংক এখন অনেকাংশে অনলাইন।

তবে বাংলাদেশে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরির বিষয়টি সামনে আসে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির পর থেকে।

মিডিয়ায় বিভিন্ন ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ চুরির খবর প্রকাশিত হলেও ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়নি।

তবে, এ বছর পয়লা জুন ঢাকার খিলগাঁও তালতলা এলাকার ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন ইউক্রেনের এক নাগরিক।

তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেই রাতে পান্থপথের হোটেল ওলিও ড্রিম হ্যাভেনে অভিযান চালিয়ে তার সহযোগী আরও পাঁচ ইউক্রেনের নাগরিককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

বাংলোদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি বিষয়ে সরকারি তদন্তকারী দলের সদস্য ড. মো. কায়কোবাদ বেনারকে বলেন, “আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর অনলাইন ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। প্রযুক্তির দিক বিবেচনা করলে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।”

তিনি বলেন, “আর সেকারণেই ফিলিপাইন, চীন, আফ্রিকা, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশের হ্যাকাররা অর্থ চুরি করতে এদেশে আসছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থেকে ৮২ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো ব্যাংকগুলো এই ঘটনাগুলো লুকিয়ে রাখছে। আর সেকারণে চোররা উৎসাহিত হয়ে এদেশে আসছে।”

অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, “আবার আমাদের দেশের অপরাধীরাও আন্তর্জাতিক এই চক্রের সাথে যোগ দিয়েছে। দুজন বাংলাদেশি তুরস্কের দুই নাগরিকের সহায়তায় ভারতে গিয়ে অর্থ চুরি করতে গিয়ে গত সপ্তাহে ধরা পড়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশে এখন টাকা জালিয়াতির দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্র গড়ে উঠেছে।”

তাঁর মতে, “সকল সমস্যার মূল হলো, আমরা ঝুঁকির বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়েই আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাকে অনলাইনে রূপান্তর করেছি।”

ভারতে দুই বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এটিএম থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা চুরির অভিযোগে দুই বাংলাদেশি ও তুরস্কের দুই নাগরিককে আটক করেছে সেদেশের পুলিশ। গত ২০ নভেম্বর ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক খবরে এ কথা বলা হয়।

পশ্চিমবঙ্গের বেলঘরিয়া থানাধীন বি.টি. রোডের এল-৯ বাস স্ট্যান্ডের পাশের একটি বহুতল আবাসনে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ।

গত বুধবার আদালতে তোলা হলে তাঁদের ১০ দিনের রিমান্ডে মঞ্জুর করেছে আদালত। অভিযুক্ত দুই বাংলাদেশি হলেন বগুড়ার মোহম্মদ হান্নান (৩০) ও সাতক্ষীরার মোহম্মদ রফিকুল ইসলাম (৪৪)। দুই তুর্কি নাগরিকের নাম ফতেহ আলদেমির (৪০) ও হাকান জানবুরকান (৫৩)।

অভিযোগ হচ্ছে, তাঁরা এটিএম এর তথ্য হাতিয়ে কার্ড ক্লোন করে ত্রিপুরা ও আসামের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিশেষ করে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ‘স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র বিভিন্ন শাখা থেকে কয়েক লাখ রুপি হাতিয়ে নিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।