এক লাখ আলেম–ওলামা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া সাক্ষর করেছেন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.15
160615-bd-islam-fatwa-620.jpg ঢাকার শাহাবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএস’র কথিত বাংলাদেশ শাখার কর্মীরাদের হাতে নিহত ধর্মনিরপেক্ষ লেখক, ব্লগার, প্রকাশকের ছবি হাতে বিচারের দাবি জানাচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষ। জুন ১৫, ২০১৬।
এএফপি

ধর্মকে ব্যবহার করে সৃষ্ট জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশের এক লাখ মুফতি ও আলেম–ওলামা ফতোয়া দিতে জাচ্ছেন, যার বিস্তারিত ১৮ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে।

কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম ও জমিয়াতুল উলামাহর চেয়ারম্যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নেতৃত্বে বিশিষ্ট আলেমরা এই ফতোয়া দেবেন। গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে এ লক্ষ্যে সাক্ষর সংগ্রহ করা হয়েছে।

শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এবং কয়েক লাখ মানুষ সেখানে নামাজ আদায় করেন। এ জন্য ওই ইমামের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে মুসলমানদের কাছে।

“বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্ব আজ কথিত জঙ্গিবাদের হুমকির মুখে। মুসলমান যুবকদের কেউ কেউ মনে করে ভিন্নমত বা ভিন্ন ধর্মের ব্যক্তি বা উপাসনালয়ে হামলা করে তারা মারা গেলে পরকালে বেহেশত পাবে। তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অসত্য। কারণ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাসবাদ ইসলাম সমর্থন করে না,” বেনারকে জানান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।

তাঁর মতে, আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বেহেশত পাওয়া সম্ভব নয়। এমন ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফতোয়ায় এমন আহ্বানই থাকবে।

গত ৩ জানুয়ারি ঢাকায় ৩০০ আলেমকে ডেকে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে তাঁদের ওপর এক লাখ আলেম-ওলামার ফতোয়া ও মতামত সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরাই সারা দেশে এই ফতোয়া সংগ্রহ করে তা চূড়ান্ত করেছেন।

৬২ পৃষ্ঠার এই ফতোয়ার কপি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া হবে। এর একটি কপি জাতিসংঘের কাছে পাঠানোর কথা বলছেন উদ্যোক্তারা।

জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক লাখ ইমামের স্বাক্ষরসংবলিত এই ফতোয়া দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

মাসউদ আরো বলেন, ‘যারা ইসলামের নামে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে, তারা বিকৃত চিন্তা–চেতনার মানুষ। এরা ইসলামের দুশমন, মুসলমানদের শত্রু। ইসলামকে পুঁজি করে যেন জঙ্গিবাদী তৎপরতা আর না হয়, সে জন্য বাংলাদেশের এক লাখ ইমাম, ওলামা-মাশায়েখ একযোগে সমর্থন দিয়ে এই ফতোয়া দিয়েছেন।

বছরখানেক আগে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটি পুস্তিকা তৈরী করে তা দেশের মসজিদগুলোতে পাঠিয়েছিল ইসলামিক ফাউণ্ডেশন।দেশের বেশিরভাগ মসজিদ ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের আহ্বানে প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন।

মাওলানা মাসউদ বলেন, “ওলামা-মাশায়েখদের বয়ান ও ওয়াজ মাহফিলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কারণ কোরআন ও হাদিসের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলার চরম ষড়যন্ত্র চলছে। সে জন্য আমরা এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছি।”

ফতোয়ায় ১০ প্রশ্ন

এদিকে ১০টি প্রশ্ন সামনে রেখে ফতোয়াগুলো চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রশ্নগুলো হলো জিহাদ ও সন্ত্রাস এক জিনিস কি না? সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে ইসলাম সমর্থন করে কি না?

অন্য প্রশ্নের মধ্যে রয়েছে, ইসলামের নামে সন্ত্রাস করে মৃত্যুবরণ করলে সে শহীদ হবে কি না এবং পরকালে জান্নাত পাওয়া যাবে কি না? নির্বিচারে মানুষ হত্যাকাণ্ড ইসলাম সমর্থন করে কি না?

এসব প্রশ্নে কোরআন ও হাদিসের আলোকে আলেম–ওলামাদের মত হচ্ছে, সবগুলো প্রশ্নের জবাব ‘না’। ইসলাম ধর্ম এগুলো সমর্থন করে না।

ইসলামের নামে হত্যা চলছেই

তবে ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহার করে দেশে জঙ্গিরা নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। গত দেড় বছরে দেশে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলায় বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা ও ধর্মের প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হয়েছেন।

গত ৫ জুন চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানমকে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন। গত শুক্রবার থেকে বুধবার পর্যন্ত এসব অভিযানে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এদের মধ্যে জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় দুইশ।

মাওলানা মাসউদ বলেন, “আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেছি যে, শুধু তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে জঙ্গি দমন হবে না। কারণ জঙ্গিরা ধর্মীয় চেতনা থেকে এই কাজ করছে। যারা জঙ্গি কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে তারা মনে করছে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে আত্মদান করলে তারা জান্নাত পাবে।”

তাঁর মতে, জঙ্গিদের এই চেতনাটা যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে আলেম-ওলামারাই তা পারবেন।

মাওলানা ফরিদউদ্দিন বলেন, “মুসলিম সমাজে ফতোয়ার বড় ধরনের প্রভাব বিদ্যমান। আমাদের দেশে কেউ কেউ ফতোয়ার অপব্যবহার করেছেন। তাই আমরা এই স্লোগানে এখন একত্রিত হচ্ছি যে ‘মানব কল্যাণে ফতোয়া’।”

“সাধারণ মানুষেরা অনেকক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে ইমামদের কথায় বেশি গুরুত্ব দেন। বিশেষ করে ধর্মীয় মতামত বিষয়ে আলেম–ওলামাদের গুরুত্ব বাংলাদেশের সমাজে অনেক বেশি। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আলেম–ওলামাদের সম্পৃক্ত করলে তাতে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি,” বেনারকে জানান ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাহেদুল আনাম খান, যিনি একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

“যে কোনও ধরণের সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে ইসলাম শুধু নয়, কোনও ধর্মই সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমরা দেশে–বিদেশে সর্বত্রই শান্তি চাই,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র মোহিতুর রহমান।

তাঁর মতে, এ দেশে জঙ্গিবাদের সঙ্গে অনেক কিছুরই সম্পর্ক আছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সুশিক্ষার অভাব, যেনতেনভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা দিয়ে বেকার তৈরীসহ বিভিন্ন কারণে জঙ্গিবাদের বিকাশ হয়। তাই শুধু গ্রেপ্তার বা প্রচারই সামাজিক এই ব্যধি নির্মূল করতে পারবে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।