ফেসবুকের ছবি নিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভাঙচুর
2016.10.31
ফেসবুকে প্রকাশিত একটি ছবিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনা সাম্প্রদায়িক হামলায় রূপ নিয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ওই হামলায় কমপক্ষে ১৫টি মন্দির এবং শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে দুষ্কৃতকারীরা।
গত শুক্রবার নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেইসবুক পাতায় একটি পোস্ট নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত। ফেইসবুকে রসরাজ ‘ইসলাম অবমাননা করে’ পোস্ট দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, রসরাজ পেশায় জেলে। লেখাপড়া জানে না। ফেসবুকে দেওয়া ছবিটি ফটোশপ করা। ছেলেটির আত্মীয়–স্বজনেরা ভয়ে এলাকাছাড়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আবদুল করিম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ছেলেটি বলছে, তার ফেসবুকে অন্য কেউ এটা পোস্ট করেছে।
এদিকে ফেসবুকে সর্বশেষ রসরাজ লিখেছেন, “কীভাবে আমার আইডি থেকে ছবিটি পোস্ট করা হলো আমি জানি না। আমি সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।”
এদিকে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠন ওই ঘটনার প্রতিবাদে রোববার বিক্ষোভের ডাক দেয়। রসরাজের শাস্তির দাবিতে একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ করে। কয়েকশ লোক সরাইল-নাসিরনগর-লাখাই সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, অবরোধ থেকে একদল লোক নাসিরনগর সদরের দত্তবাড়ির মন্দির, নমশুদ্রপাড়া মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, ঘোষপাড়া মন্দির, গৌরমন্দিরে হামলা চালায়। এ সময় উপজেলা সদরের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা হয়।
মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় নাসিরনগর থানায় গতকাল সোমবার দুটি মামলা হয়েছে। উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি দুর্গামন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় কাজল জ্যোতি দত্ত ও সদরের মহাকালপাড়া গৌর মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় নির্মল চৌধুরী বাদী হয়ে মামলা দুটি করেন।
প্রতিটি মামলায় ১০০০ থেকে ১২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হামলার পর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অক্টোবর ২৯, ২০১৬। স্টার মেইল।
নাসিরনগর উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আদেশ চন্দ্র দেব বেনারকে বলেন, “ফেসবুকের একটা ছবি নিয়ে শনিবার থেকেই এলাকায় উত্তেজনা ছিল। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে দুটি সংগঠনকে ধর্মীয় সমাবেশ করার অনুমতি দেয় প্রশাসন।”
তবে স্থানীয় একাধিক সাংবাদিক বেনারকে জানান, গৌর মন্দির নাসিরনগরের সবচেয়ে বড় মন্দির। গৌর মন্দিরে পুলিশ থাকলেও তারা হামলাকারীদের ঠেকাতে পারেনি।
গৌর মন্দিরের পুরোহিত শংকর গোপাল দাস হামলাকারীদের হামলায় আহত হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ঘটনার সময় তিনি দরজা আটকে পূজা করছিলেন। দরজা ভেঙে তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়।
অভিযোগ উঠেছে রোববার সমাবেশ চলাকালে পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দির, নমশূদ্র পাড়ার কালীবাড়ি মন্দির, মহাকাল পাড়ার শিবমন্দির, দুর্গামন্দির, শীলপাড়ার লোকনাথ মন্দির, দত্তপাড়ার দত্তবাড়ি মন্দির, সূত্রধরপাড়ার কালীমন্দিরসহ আরও সাতটি পারিবারিক মন্দিরে পুলিশ ছিল না।
এ প্রসঙ্গে নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাদের বেনারকে বলেন, “পুলিশের মনযোগ ছিল সমাবেশের দিকে। তা ছাড়া হামলাকারীরা সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে, কিছুই করার ছিল না। তারপরও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফাঁকা গুলি ছোঁড়াসহ সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে।”
শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ
মন্দির ও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গতকাল বিকেলে নাসিরনগর উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদ মিলনায়তনে শান্তি ও সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে জেলা প্রশাসক রেজওয়ানুর রহমান বলেন, একটি ঘটনা নাসিরনগরের এত দিনের সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে না। এলাকায় সবাই ভাই-ভাই। এক ভাই অন্য ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে না।
পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সমাবেশে বলেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার, ইউএনও চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ, উপজেলা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের আহ্বায়ক রিজয়াজুল করিম, খাঁটি আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম শহীদুল হক প্রমুখ।
সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে মন্দিরে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন। গতকাল এসব সংগঠন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের বিচারেরও দাবি জানায়।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) এক বিবৃতিতে বলা হয়, ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননার প্রতিবাদে পরিকল্পিতভাবে নাসিরনগরের বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। এই ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসক দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে ওই এলাকার সংখ্যালঘু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ বিরোধী মঞ্চ এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল পৃথক বিবৃতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক হামলার নিন্দা জানিয়ে সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছে। বাংলাদেশ ছাত্র যুব ঐক্য পরিষদ হামলার বিচার দাবিতে সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে।