দুই মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ,পদে থাকা নিয়ে প্রশ্ন
2016.09.01
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারের দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ আনায় তাঁরা নিজ নিজ পদে বহাল থাকতে পারেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জোরেশোরে।আদালত অবমাননার দায়ে দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়।
আইনজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান বা আইনে শপথ ভঙ্গের বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই।তবে নৈতিক কারণে তাঁদের এই পদে থাকার সুযোগ নেই বলে তাঁদের মত।
সরকারের ওই দুই মন্ত্রী হলেন; খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
এর আগে তাঁদের দোষী সাব্যস্ত করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ গত ২৭ মার্চ রায় দেন। রায়ে প্রত্যেক মন্ত্রীকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁরা সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে জরিমানার ওই টাকা পরিশোধ করেছেন।
গত ৬ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির আদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর আপিল মামলা পুনরায় শুনানির দাবি জানান।
ওই শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে অংশ না নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতি ও মীর কাসেমের মামলার রায় নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন।
বিচারাধীন এ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর হৈচৈ পড়ে যায়। গত ৮ মার্চ আপিল বিভাগ জামায়াত নেতা মীর কাসেমের আপিলের রায় ঘোষণা করেন এবং এতে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে।
গত মঙ্গলবার মীর কাসেমের রিভিউ আবেদনও খারিজ হয়ে গেছে। এখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ বাকি আছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে ৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেল।
সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ওই রায়ে বলা হয়েছে, দুই মন্ত্রী আইন লঙ্ঘন করেছেন এবং সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানে তাঁদের শপথ ভঙ্গ করেছেন।
“রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে দুই মন্ত্রী শপথ ভঙ্গ করেছেন। তবে শপথ ভঙ্গ করলে কি হবে, তা সংবিধানে বলা নেই,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার, যিনি খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের আইনজীবী।
গত ২৭ মার্চ ওই রায় প্রকাশ হওয়ার পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে কথা বলবেন। কিন্তু গতকাল রায় প্রকাশ হওয়ার পর যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী বেনারকে বলেন, রায়টি পড়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাব।
“আমি তো মনে করি, পুরো বিষয়টির সঙ্গে নৈতিক দিকটি গভীরভাবে জড়িত। সুতরাং তাঁদের উচিত হবে অবিলম্বে স্ব স্ব পদ থেকে পদত্যাগ করা,” বেনারকে জানান সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, যিনি বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা।
রায়ে যা বলা হয়েছে
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী রায়ে বলেছেন, সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে আইন অনুযায়ী রায় দেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে। অথচ বিবাদীরা সুপ্রিম কোর্টের কী সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা উচিত সেই নির্দেশ দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন।
রায়ে আরও বলা হয়, সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন রক্ষার যে শপথ বিবাদীরা নিয়েছেন, সে দায়িত্বের প্রতি তাঁরা অবহেলা করেছেন। এতে আরও বলা হয়েছে, বিবাদীরা (দুই মন্ত্রী) ন্যায়বিচার প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিচার বিভাগের পবিত্রতাকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন।
রায়ে আরও বলা হয়, সংবিধান অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত আইন যা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সবাইকে আইন মানতে হয়। আদালতের রায়কে প্রভাবিত করতে বিবাদীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে কুৎসা রটিয়েছেন। এটা গুরুতর ফৌজদারি অবমাননা ও সংবিধানের লঙ্ঘন। এই অবমাননাকারী কোনো সহানুভূতি পেতে পারেন না।
শপথ ভঙ্গের বিষয়ে ভিন্নমত
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর দেওয়া রায়টি পড়ার কথা উল্লেখ করে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর রায়ে বলেছেন, “অবমাননাকারীদের (দুই মন্ত্রী) দোষী সাব্যস্ত করা ও দণ্ড প্রদানের বিষয়ে দ্বিমত পোষণের প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু আমি অবমাননাকারীদের ‘শপথ লঙ্ঘন’ অংশের সঙ্গে একমত পোষণ করতে পারছি না।”
এর পক্ষে যুক্তিতে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী রায়ে বলেছেন, অবমাননাকারীরা তাঁদের শপথ ভঙ্গ করেছেন বা করেননি—এখানে তা বিচার্য বিষয় ছিল না।
তা ছাড়া ওই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অবমাননাকারী-বিবাদীদের প্রতি কোনো নোটিশ ইস্যু করা হয়নি, যাঁরা মন্ত্রী সভার সদস্য।
“দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া সংবিধানের ১৫৩ টি অনুচ্ছেদের কোন একটি বিধান লঙ্ঘন করলে কি পরিনতি হবে তা সংবিধানে বলে দেওয়া না,” বেনারকে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি আরও বলেন, শপথ ভঙ্গ করার পর সাংবিধানিক পদে কোনো ব্যক্তির পদ আঁকড়ে থাকার নৈতিক ও সাংবিধানিক অধিকার নেই।