ভারতকে নৌ ট্রানজিট দিল বাংলাদেশ
2016.06.02

অনেক দেনদরবারের পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে ভারত। প্রথমবারের মতো টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুলে নৌপথে এ ট্রানজিট সুবিধার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রশ্ন উঠেছে এই মাশুল মূল্য নিয়ে।
অভিযোগ উঠেছে, মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ মানা হয়নি।তবে সরকার বলছে, ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ ছিল ‘একতরফা’।
পণ্য পরিবহনে ভারত যে সুবিধা পাবে, তার তুলনায় এ মাশুল যৎসামান্য বলছেন বিশ্লেষকেরা। তবে সরকার বলছে, দর–কষাকষিতে লাভজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ।
“দুই দেশের নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা থেকে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পণ্য নিতে ট্রানজিটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে,” বেনারকে জানান নৌ পরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়।
জানা যায়, ট্রানজিট নৌ প্রটোকলের আওতায় হলেও পণ্য পরিবহন করা হবে বহুমাত্রিক ব্যবস্থায়। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ পর্যন্ত নৌপথে পণ্য নেওয়ার পরে তা আশুগঞ্জ থেকে সড়কপথে আগরতলায় নেওয়া হবে।
সরকারি সূত্রে জানা যায়, ট্রানজিটের প্রথম চালান হিসেবে এক হাজার টন ঢেউটিন যাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আগরতলায়। গত ১৫ মে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুল ধরে ঢেউটিনের চালানটি কলকাতা থেকে আগরতলায় নেওয়ার অনুমতি দেয়। এখন যেকোনো সময় চালনাটি যেতে পারে।
এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ট্রানজিট চালান নেওয়ার অনুমতির জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে আবেদন জমা পড়েছে।
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ মানা হয়নি
সড়ক, রেল ও নৌ পথে ভারত, নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট দিতে ২০১১ সালে ট্যারিফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি নৌপথে পণ্য পরিবহনে টন প্রতি ১ হাজার ৫৮ টাকা নির্ধারণ করে।
তবে মাশুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে সুপারিশ মানা হয়নি। বরং তার চেয়ে পাঁচ গুণেরও কম মাশুল নির্ধারণ হওয়ায় সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে ওই কোর কমিটি প্রধান মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “বিনিয়োগ, ট্রানজিটের সম্ভাব্যতা, পণ্য পরিবহন প্রবাহসহ নানা বিষয়ে হিসাব করেই যৌক্তিকভাবেই মাশুল নির্ধারণ করেছিল ওই কমিটি। তবে এখন নৌপথের মাশুল নির্ধারণ কোন বিবেচনায় করা হয়েছে জানি না।”
জানা যায়, নৌপথে ট্রানজিটের অনুমতি দিলেও এখনই সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ রেলপথের অবকাঠামো সংকট। ট্রানজিটের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পরেই এ বিষয়ে অনুমতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া সড়কপথে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে ট্রানজিট চালুর প্রক্রিয়াও প্রায় বছর ধরে আটকে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌ সচিব অশোক মাধব রায় বলেন, নৌ ট্রানজিটের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সময়ে এ পথে ট্রানজিট শুরু হবে। উভয় পক্ষের দর-কষাকষির ভিত্তিতেই মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে।
‘ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন এক তরফা’
নৌ সচিব বলেন, “একতরফাভাবে মাশুল নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দিয়েছিল ট্যারিফ কমিশন। নিয়ম অনুযায়ী একটি দেশের কোন কমিশনের নির্ধারণ করে দেওয়া মাশুল অপর পক্ষ মানতে রাজি হয় না। এটা সরকারি কোন আদেশ নয়। দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতিতেই মাশুল নির্ধারিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “নিজেরা নিজেরা মাশুল বাড়িয়ে ধরা যায়। কিন্তু আলোচনার সময় আন্তর্জাতিক দরদাম দেখেই তা চূড়ান্ত করতে হয়।ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। তবে অনেক যুক্তিতর্কের পরে ১৯২ টাকা নির্ধারণ হয়েছে।”
নির্ধারিত মাশুলে বাংলাদেশের লোকসান হওয়ার সুযোগ নেই বলেও তিনি জানান।
এত কম মাশুল ধরার যুক্তি নেই
নৌপথ ট্রানজিটের নির্ধারিত মাশুল নির্ধারণের পক্ষে যুক্তি দেখছেন না বিশ্লেষকেরা। এতে কানেকটিভিটি বাড়লেও, বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ট্যারিফ কমিশন যে মাশুল নির্ধারণের সুপারিশ করেছিল, তার পক্ষে যুক্তি ছিল। কিন্তু ১৯২ টাকা দরে যে মাশুল নির্ধারিত হল, তার সমর্থনে যুক্তিই দেখি না। সরকারও স্পষ্ট করছে না। কোথায় যেন কোন গোপনীয়তা রয়েছে। এটা ঠিক নয়।”
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “সে সময় ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ। অথচ বাংলাদেশের প্রায় ১৭ লাখ শরণার্থীকে তারা আশ্রয় দিয়েছিল ভারতের এই রাজ্য। সে উপকারের কথা মনে রেখে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে ত্রিপুরার জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। তাই বলে মাশুল কমাতে হবে, এটা মানা যায় না।”
“কানেকটিভিটির যুগে এর মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হল, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুবিধা পেল না বাংলাদেশ,” বলেন এই কূটনীতি বিশ্লেষক।