বিরোধী দল দমনের ফলে জঙ্গি উত্থান হতে পারে: মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান
2016.02.10
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দল দমনের যে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী বা জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের পথ প্রশস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেমস ক্ল্যাপার।
বার্তা সংস্থা এপি জানায়, মঙ্গলবার জেমস ক্ল্যাপার দুটি বিষয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একটি হচ্ছে; মানুষ কেন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক হত্যায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর হাত রয়েছে। অপরটি হচ্ছে; শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতেই এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
সিনেটে বিশ্বব্যাপী হুমকি নিয়ে আয়োজিত শুনানিতে লিখিত বিবৃতি দেন জেমস ক্ল্যাপার।
অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ সরকারের মন্ত্রী এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাঁদের বক্তৃতা–বিবৃতিতে বিদেশি নাগরিক হত্যায় বিএনপি–জামায়াতের হাত থাকার কথা বলে আসছেন।
একই সঙ্গে সরকারকে বিপদে ফেলা ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে তাঁরা মত দিয়ে আসছেন।
“বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে ছোট করে দেখা বা দমন করার প্রশ্নই আসে না। নিবন্ধিত এবং আইনসিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক সব অধিকার ভোগ করে। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না,” বেনারকে জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গণতন্ত্র ও নির্বাচনকে স্যাবোটাজ করার জন্য আগুন সন্ত্রাস ও নাশকতার মাধ্যমে নিজেই নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
“গণতন্ত্রের মাঠ থেকে সরে গিয়ে তিনি জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধী, নাশকতা কারি ও আগুন সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করেছেন। এখন রাজনীতির মাঠে তিনি কীভাবে ফিরবেন সেই সিদ্ধান্ত ওনাকেই নিতে হবে,” জানান হাসানুল হক।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান হচ্ছে ‘জিরো টলারেন্স’। বিএনপি–জামায়াত জঙ্গিবাদের মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষক, এ কথা নানাভাবে প্রমাণ হচ্ছে এবং এ কারণে ওই দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার চলছে।
এদিকে মার্কিন সিনেটে বিশ্বব্যাপী হুমকি নিয়ে আয়োজিত শুনানিতে লিখিত বিবৃতিতে জেমস ক্ল্যাপার ১১ জন বিদেশি ও সংখ্যালঘুর ওপর হামলায় ইসলামিক স্টেটের দায় স্বীকারের কথা উল্লেখ করেছেন।
পাশাপাশি এও বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকার দেশটিতে আইএস জঙ্গিদের উপস্থিতি নেই বলে দাবি করে আসছে। সরকারটির দাবি এসব সহিংস ঘটনায় স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী ও বিরোধী দল জড়িত।
সিনেটের বিবৃতিতে বলা হয়, ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে কমপক্ষে ১১ জন প্রগতিশীল লেখক ও ব্লগার হত্যার দায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও ভারতীয় উপমহাদেশ ভিত্তিক আল কায়েদা দায় স্বীকার করে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকার বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান হচ্ছে, আনসারউল্লাহ এসব ঘটনায় জড়িত। ওই সব হত্যাকাণ্ডের পর গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের বেশির ভাগই আনসারউল্লাহর সঙ্গে জড়িত বলে র্যাব বা পুলিশ গণমাধ্যমকে জানায়।
যদিও ওই সংগঠনের দৃশ্যমান কোনো অস্তিত্ব নেই। আনসারউল্লাহর সাংগঠনিক কোনো কাঠামো, কর্মকাণ্ড বা দৃশ্যমান নেতা নেই।
“বাংলাদেশে আল-কায়েদার নেটওয়ার্ক আছে, এমন কোনো আমাদের কাছে তথ্য নেই । তবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আল-কায়েদার অনুসারী। দীর্ঘদিন ধরে আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত হতে চেষ্টা করছে সংগঠনটি। তবে তারা যুক্ত হতে পেরেছে এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই,” সম্প্রতি বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম।
দেশে জঙ্গিবাদের পরিস্থিতিতে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই উল্লেখ করে মনিরুল আরো বলেন, পুলিশ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান ছাড়াও অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের বিচার চলছে।
এদিকে সিনেটের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। তবে ঐতিহ্যগতভাবে দেশটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং পরধর্মসহিষ্ণু। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে।
এপির খবরে বলা হয়, বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নৃশংসতার অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিরুদ্ধে চলা বিচারের কারণে দেশের ভেতর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
“যারা দেশ শাসন করে তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কিন্তু বর্তমান সরকারের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায় এবং এ কারণেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ব্যাহত হচ্ছে,” বেনারকে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকার যেহেতু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি এবং কাছাকাছি সময়ে নির্বাচনের সম্ভাবনা নেই, সেহেতু গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলার চেয়ে যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার।
“এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত, সরকারকে শক্তি প্রয়োগের জায়গা থেকে সরে গিয়ে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিএনপিকেও প্রতিহিংসা ও সহিংসতার রাজনীতি ছাড়তে হবে। আর এটা করতে পারলে জঙ্গিবাদের উত্থান যেমন ঠেকানো সম্ভব হবে, তেমনি গণতন্ত্র ফিরে আসার পথ প্রশস্ত হবে,” মনে করেন ড. লতিফ মাসুম।