ড. ইউনূসের সঙ্গে রাজস্ব বোর্ডের মত পার্থক্য, ইউনূস সেন্টারের জবাব
2015.03.24
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আয়-ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তিনি যে অর্থ দান করেছেন, তা বিধিসম্মত হয়নি বলে মনে করছে কর বিভাগ। তবে এ নিয়ে নোবেল বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস উচ্চ আদালতে রেফারেন্স করেন ।
এ অবস্থায় বিষয়টি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি করতে ২৯ মার্চ কর অঞ্চল-৬ কমিশনার কার্যালয়ে আলোচনার জন্য ড. ইউনূস কিংবা তাঁর প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কর কমিশনার মেফতাহ উদ্দিন খান। গত সোমবার বিকেলে এ কর অঞ্চলের ১১৪ নম্বর সার্কেল থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর প্রেক্ষিতে ড. ইউনূসের পক্ষে মঙ্গলবার ইউনূস সেন্টারের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর লামিয়া মোর্শেদ সাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রফেসর ইউনূস বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অনেক উচ্চ ফি নিয়ে বক্তৃতা করে থাকেন।অনেক শ্রোতা দর্শনীর বিনিময়ে তার কথা শুনতে আসে। তাঁর বেশ কয়েকটি বই বিশ্বের ২৫টি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।কিছু বই নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
এসকল বক্তৃতা, বই ও প্রাইজের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ তিনি বাংলাদেশে ব্যাঙ্কের বৈধ চ্যানেলে নিয়ে আসেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত আয়কর প্রফেসর ইউনূস নিয়মিত পরিশোধ করে আসছেন। ২০১১ থেকে ২০১৪ অর্থবছরের অর্জিত প্রায় সমূদয় আয় তিনি দান করেছেন। এই অর্থের পরিমান ৭৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা।কর পরিশোধের পর ৭৭ কোটি টাকা তিনি মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট-এর মাধ্যমে অনুদান, গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়নের খাতে দান করেছেন। তার মধ্যে ৫ কোটি টাকা পারিবারিক কল্যাণের জন্য ইউনূস ফেমিলি ট্রাস্টকে দিয়েছেন।সব দান ও অনুদান তিনি ট্যাক্স রিটার্নে দেখিয়েছেন।কর কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনো প্রশ্ন তোলে নাই, এবং তাকে ট্যাক্স পেমেন্ট সার্টিফিকেটও দেয়া হয়।
২০১৪ সালের মে মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রফেসর ইউনূসকে এক নোটিশ দিয়ে জানায় তাকে গিফট ট্যাক্স পে করতে হবে ১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। তিনি তখন আদালতের দারস্থ হন, ১৯৯০ সালের গিফট ট্যাক্স আইন অনুসারে সকল অনুদানই করমুক্ত।প্রফেসর ইউনূস এ নিয়ে উচ্চ-আদালতে আপীল করেছেন। আপীল শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।
এরই মধ্যে রাজস্ব বোর্ড গত ২৩ মার্চ এক নোটিশ দিয়ে প্রফেসর ইউনূসকে তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে আগামি ২৯ মার্চ কর কমিশনারের কাছে হাজির হয়ে দেখা করতে বলে।তাঁর গিফট ট্যাক্স ইস্যুটি বর্তমানে আদালতে থাকা সত্তেও তাঁর প্রতিনিধি নির্ধারিত তারিখে কমিশনারের সঙ্গে দেখা করবেন।
উল্লেখ্য, প্রফেসর ইউনূস বর্তমানে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেবার জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন।
এনবিআর দাবি করছে, ২০১১-১২, ২০১২-১৩ ও ২০১৩-১৪ করবর্ষে জমা দেওয়া বার্ষিক আয়কর বিবরণী অনুযায়ী যে পরিমাণ অর্থ তিনি দান করেছেন, তার ওপর কর দেননি। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দানকর বাবদ ১৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা জমা করেননি ড. ইউনূস। কিন্তু ড. ইউনূসের আইনজীবীরা এ দাবি না মেনে গত বছর কর ট্রাইব্যুনালে আপিল করেন। ট্রাইব্যুনালে আপিল করার শর্ত হিসেবে সে সময় সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে ১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা কর দেন ড. ইউনূস। পরে ট্রাইব্যুনাল এ আপিল খারিজ করে দেন। এরপর ৫ মার্চ ড. ইউনূসের আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত রেফারেন্স মামলা করেন। রেফারেন্স মামলার শর্ত হিসেবে আবার দুই কোটি সাত লাখ টাকা কর হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে জমা দেওয়া হয়। এর ফলে ড. ইউনূসের কাছ থেকে ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা দাবি করছে কর বিভাগ।
কর অঞ্চল-৬-এর কমিশনার মেফতাহ উদ্দিন খান বলেন, ‘বকেয়া কর কীভাবে সমঝোতার মাধ্যমে আদায় করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেই ওনাকে (ড. ইউনূস) কিংবা তাঁর প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। উনি করদাতা হিসেবে বেশ ভালো, নিয়মিত কর দেন। কর বিভাগকে সহায়তা করেন।’ তিনি জানান, ৫০ লাখ টাকার ওপরে যেসব করদাতার কাছে কর বকেয়া রয়েছে, তাঁদের প্রতিবছরই এ ধরনের সমঝোতা বৈঠকে ডাকা হয়। গত বছরও ড. ইউনূসের প্রতিনিধি এসে এ ধরনের সভা করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কর পরামর্শক ও সাবেক কর কমিশনার মাহবুবুর রহমান বলেন, যে টাকা দান করেছেন, এর উৎস আয়কর বিবরণীতে দেখিয়েছেন ড. ইউনূস। এ টাকা পুরোপুরি সাদা। আর বিদেশ থেকে উপার্জিত অর্থ তিনি বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশে এনেছেন, তা করমুক্ত। তিনি আরও জানান, তিনি (ড. ইউনূস) যেসব খাতে দান করেছেন, তা দানকর আইনে কর অব্যাহতি দেওয়া আছে।
এর আগে ২০১২ সালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রবাসী-আয় নিয়ে খোঁজখবর নিয়েছিল এনবিআর। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকাকালে ড. ইউনূস ওয়েজ আর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কি না, এনে থাকলে কী পরিমাণ কর অব্যাহতি নিয়েছেন, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এনবিআরকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের প্রবাসী-আয় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি কর বিভাগ। এ ছাড়া সে সময় গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয়ের খোঁজ নিয়েছিল এনবিআর।