একাত্তরের বন্ধু জ্যাকবকে হারালো বাংলাদেশ
2016.01.13

একাত্তরের অকৃত্রিম ভারতীয় বন্ধু লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জেএফআর জ্যাকবকে হারালো বাংলাদেশ। বুধবার সকালে দিল্লির একটি সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
এদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কয়েকজন বিদেশি বন্ধুর অবদান উজ্জল ভাস্বর হয়ে আছে, তাদের মধ্যে প্রথম সারিতেই রয়েছেন জেনারেল জ্যাকবের নাম। ১৯৭১-এ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া নিজ হাতেই লিখেছিলেন তিনি। মুক্তির লড়াইয়ে অবদান রাখা এই বন্ধুর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছে পুরো জাতি।
‘সৈনিকের মতই মৃত্যু’
ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম বরাতে জানা যায়, ৯২ বছর বয়সী এই ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্মকর্তা স্মৃতিভ্রমসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০১৬ সালের প্রথম দিনেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত জেনারেল জ্যাকবকে একটি সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বুধবার সেখানেই মারা যান তিনি।
তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী কিম বাহাদুরকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মৃত্যুর আগের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চেতনা জাগ্রত ছিল জেনারেল জ্যাকবের। এবং একজন সৈনিকের মত মুখে হাসি নিয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন তিনি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত জেনারেল জ্যাকব
বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’র সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা জেএফআর জ্যাকবের নাম। যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণ পণ লড়াই করছে বাঙালি জাতি। সে যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে বাঙালিদের পক্ষে রণাঙ্গনে সরাসরি যোগ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করেন, তাতে যোগ দেয় ভারতীয় সেনানায়করাও। তখন জেনারেল জ্যাকব ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অব স্টাফ। আর তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল স্যাম মানেকশ।
১৯৭১ সালেল ডিসেম্বর মাস। যৌথবাহিনীর দুর্ধর্ষ হামলায় পাকিস্তান বাহিনী তখন প্রায় বিপর্যস্ত। ঠিক সে মুহুর্তে মানেকশ মুক্তিযুদ্ধের সমর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন জ্যাকবের ওপর।
তার অবদানের বিষয়ে মুক্তি সংগ্রামের সেসব দিনের ইতিহাস হাতড়ে মুক্তিযুদ্ধে 'এস ফোর্স' এর অধিনায়ক ও সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বেনারকে বলেন, “দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল জ্যাকব বাঙালির জাতির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছিলেন। বিধ্বস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা থেকে শুরু করে তাদের আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া পর্যন্ত নিজ হাতেই তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই দলিলেই স্বাক্ষর করেন পাক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজী। শুধু তাই-ই নয় এই বিচক্ষণ ভারতীয় সেনাকর্মকর্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পুরো পরিকল্পনা নিজেই ঠিক করেছিলেন।"
জ্যাকবের কথা বলতে গিয়ে যেন সেই পুরোনো দিনে ফিরে গিয়েছিলেন সময় নায়ক সফিউল্লাহ। বলেন, জ্যাকবের নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যায়। যুদ্ধ জয় করতে ঢাকা দখলের প্রয়োজনীয়তা অনুভর করেই বিচক্ষণ জ্যাকব সেনা সদর দপ্তরের সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত স্বত্বেও ঢাকার দিকে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যায়। আগে থেকে এসব এলাকায় শত্রুর অবস্থান জানায় মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সাহায্য করছিলেন।
অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় সেনারা পাক বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়। তাদের এহেন আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী কিছুটা মানসিকভাবেও দূর্বল হয়ে পড়ে। যার ফল পাওয়া যায় মাত্র এক সপ্তাহে। ছয় দিনে মূল গন্তব্যে পৌঁছে যায় জ্যাকবের সৈন্যরা।
সফিউল্লাহ জানান, চূড়ান্ত পরাজয় জেনেও ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করতে গড়িমসি করে। পরে পাকিস্তানি সেনানায়ক নিয়াজীকে আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণে রাজি হতে বাধ্য করেন জেনারেল জ্যাকব।
তবে জেনারেল জ্যাকব মৃত্যুর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা লিখে গেছেন তাঁর কয়েকটা বইয়ে। ‘সারেন্ডার ইন ঢাকা, বার্থ অফ এ নেশন’ এবং ‘অ্যান ওডেসি ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’ নামের বইগুলিতে বাংলাদেশের এই বন্ধু জানিয়ে গেছেন স্বাধীনতার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ইতিহাস। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস।
‘মন থেকেই বাংলাদেশকে ভালবাসতেন’
জেনারেল জ্যাকবের আরেক সহযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ারভাইস মার্শাল (অব:) একে খন্দকার দিনশেষে বেনারের কাছেই ভ্রাতৃপ্রতীম এই বন্ধুর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারেন।
প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে মন থেকেই ভালবাসতেন জেনারেল জ্যাকব। খুব কাছ থেকে সেটা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। শুধু মক্তিযুদ্ধের সময়টাতেই নয়, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সময়েও সে দৃষ্টান্ত তিনি রেখেছেন। তাঁর মৃত্যুতে পুরো জাতি মর্মাহত হয়েছে।”
অবদানের কথা স্মরণ করবে জাতি
বাঙালি জাতির এই বন্ধু জ্যাকবের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলে জানান তারা।
রাষ্ট্রপতি তাঁর শোকবার্তায় বলেন, “তাঁর অবদানের কথা চিরদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে বাঙালি জাতি।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অকুতোভয় সেনানীকে হারালাম।
উভয়ই জেনারেল জ্যাকবের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘জাতির সংকটকালে অসামান্য অবদানের জন্য সবসময়ই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে ভারত।’ টুইটারে তাঁর সঙ্গে নিজের একটি ছবিও প্রকাশ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা
দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১২ সালের ২৭ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকবের হাতে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা তুলে দেন। এদিন এ সম্মাননা গ্রহণ করেন বাংলাদেশের আরো ৮৩ জন বিদেশি বন্ধু। এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা।
সেদিন সম্মাননা গ্রহনের পর জেএফআর জ্যাকব মঞ্চের দর্শকদের সঙ্গে জোর গলায় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান বলে ওঠেন। এটাই ছিল তাঁর শেষ বাংলাদেশ ভ্রমন।
এক নজরে জেনারেল জ্যাকব
পুরো নাম জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব। ১৯২৩ সালে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক ইহুদি পরিবারের তিনি জন্ম নেন।
দার্জিলিংয়ে পড়ালেখা করা জ্যাকব ১৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ সরকারের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পেশাগত জীবনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন তিনি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর সাহসিকতার অবদান স্বরূপ অর্জন করেন নানা পদক। জ্যাকব ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান। এরপর যোগ দেন রাজনীতিতে। ব্যক্তিগত জীবনে চিরকুমার জ্যাকব পাঞ্জাব ও গোয়ার গভর্নরের দায়িত্বও পালন করেন।