অভিজিৎ ও অনন্ত হত্যায় জড়িত তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার
2015.08.18

বিজ্ঞানমনস্ক লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায় ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করার দাবি করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন–র্যাব।
রাজধানীর নীলক্ষেত ও ধানমণ্ডি এলাকা থেকে গত সোমবার রাতে এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের দাবি করা হয়, যাঁরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে র্যাব।
তবে আসামীদের গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়ায় চিরাচরিত সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। র্যাব অবশ্য বলেছে, আসামীরা হেফাজতে থাকা অবস্থায় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, যদিও মাঝেমধ্যে র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে আসামীদের কথা বলতে দেওয়া হয়।
“আটক ব্যক্তিরাই ব্লগার অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী,” সংবাদ সম্মেলনে জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান।
আটক তিনজন হলেন; হলেন-তৌহিদুর রহমান (৫৮), সাদেক আলী ওরফে মিঠু (২৮) ও আমিনুল মল্লিক (৩৫)। এদের মধ্যে র্যাবের দাবি অনুযায়ী, তৌহিদ আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের অর্থের যোগানদাতা, তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। বাকি দুজন ওই জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য।
অবশ্য সংবাদ সম্মেলন শেষে সাদেক সাংবাদিকদের কাছে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন।
“দুটি হত্যাকাণ্ডের সময়ই আমি ঢাকায় বোনের বাসায় ছিলাম,” বেনারকে জানান সাদেক।
৫ হত্যাকারীর নাম জানালো র্যাব
মুফতি মাহমুদ খানের ভাষ্য, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে রমজান, নাঈম, জুলহাস, জাফরান ও সাদিক অংশ নেয়। তাৎক্ষণিকভাবে এদের পুরোনাম জানাতে পারেনি র্যাব।
তিনি আরো বলেন, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের তিন ঘণ্টা আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের মাঠে ওই পাঁচজন জড়ো হয়। সেখানে দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে রমজান ও নাঈম বইমেলায় গিয়ে অভিজিৎকে অনুসরণ করে। পরে অভিজিৎকে তারা কুপিয়ে হত্যা করে।
এই পাঁচ জনের দলটিই ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করে বলে দাবি মুফতি মাহমুদের।
তবে এরা যে হত্যায় জড়িত তা গতকাল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত নিশ্চিত করেনি অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ ঢাকা মহাগনর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। মঙ্গলবার বিকেলে এই তিনজনকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাব।
“এই তিনজনকে কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। বিষয়টি নিয়ে আলাপ–আলোচনা চলছে,” রাত সাড়ে নয়টায় বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎকে হত্যা করা হয়, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পদার্থবিজ্ঞানী অজয় রায়ের ছেলে। দেশ–বিদেশে সমালোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের গত ছয় মাসে চিহ্নিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী।
যেভাবে গ্রেপ্তার হলো
আসামীদের উপস্থিতিতে গত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান জানান, সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর নীলক্ষেত থেকে প্রথমে সাদেককে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে, তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত সাড়ে ১২টার দিকে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে তৌহিদুর ও আমিনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের ওই কর্মকর্তার দাবি, তৌহিদ ও সাদেক প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিজিৎ ও অনন্ত হত্যায় পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন।
আসামীদের সম্পর্কে তথ্য
র্যাব জানায়, সাদেকের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর নীলক্ষেতে। এখানে তাঁর বাবার রেস্তোঁরার ব্যবসা রয়েছে। ওই রেস্তোঁরার সামনে একটি প্রেসে আনসারুল্লাহর প্রধান জসীমউদ্দীন রাহমানির বই ছাপানো হতো। মাঝে মাঝে জসীমউদ্দীন সেখানে আসতেন।
রেস্তোঁরার কাজের ফাঁকে প্রেসের কম্পিউটারে বসে কম্পোজ করাসহ বিভিন্নকাজ শিখছিলেন সাদেক। সেখানেই ২০০৭ সালের দিকে রাহমানির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে মাস্টার্স পাশ করেন সাদেক।
সম্প্রতি সাদেক ৩৪ তম বিসিএস’র লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে রাহমানির ভক্ত হয়ে যায় সাদেক। জসীম উদ্দিন রাহমানী গ্রেপ্তার হওয়ার পরে কাশিমপুর কারাগারে তাঁর সঙ্গে দেখা করে সংগঠন পরিচালনার নির্দেশনা নিয়ে আসতেন তাঁর ভাই আবুল বাশার।
সাদেক দুইবার বাশারের সঙ্গে কাশিমপুর কারাগারে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ গত ২১ মে একটি নতুন চশমা, ইসুবগুলের ভুষি ও কিছু ওষুধ কাশিমপুর কারাগারে রাহমানীকে দিয়ে আসেন সাদেক। রাহমানি জেল থেকে তৌহিদুরের মাধ্যমে প্রধান হত্যাকারী রমজান ও নাঈমের কাছে নির্দেশনা পাঠাতেন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারের পর সাদেক তাদেরকে জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা দিতেন ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর রহমানও। আর দুটি ঘটনাতেই মূল হত্যাকারী ছিলেন রমজান ও নাঈম।
কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তার ব্রিটিশ নাগরিক তৌহিদুর একসময় বিমানে চাকরি করতেন। ১৯৯১ সালে তিনি যুক্তরাজ্যে যান। ২০০৮ সালের দিকে জসিম উদ্দীন রাহমানি সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি প্রায়ই জসীম উদ্দীনকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করতেন।
মূল হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে সন্দেহ
গ্রেপ্তারকৃত আরেক জন আমিনুল মল্লিক পাসপোর্টের দালাল। তাঁর মাধ্যমেই ভুয়া নাম দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে দেশের বাইরে পালিয়েছেন আনসারুল্লাহর পলাতক সদস্যরা।
“আমরা চাই সব ব্লগার হত্যার বিচার হোক। কিন্তু কোথায় যেন আন্তরিকতায় ঘাটতি লক্ষ্য করছি,” জানান সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
তাঁর মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী যে দাবি করে, পরবর্তীতে ওই দাবির সতত্যা অনেকক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না।