ভেজাল ওষুধ তৈরির সাজাঃ ২৩ বছর পরে ৬ জনকে ২০ বছরের দণ্ড
2015.08.18

২৩ বছর আগে ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে ৭৬ শিশু মারা যাওয়ার ঘটনায় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বিসিআই বাংলাদেশ ফার্মার ছয় কর্মকর্তাকে দুটি মামলায় ১০ বছর করে ২০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন বাংলাদেশের একটি আদালত। দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে পাঁচজন বর্তমানে পলাতক রয়েছেন।
ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ ও ড্রাগ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান গত সোমবার এ রায় ঘোষণা করেন। এছাড়া কারাদণ্ডের পাশাপাশি প্রতিটি মামলায় প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। এই জরিমানা পরিশোধ না করলে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে তাদের।
রায়ে বলা হয়েছে, একটি মামলায় সাজা শেষ হলে কারাবিধি অনুযায়ী আরেক মামলায় সাজা কার্যকর হবে।
আসামি যারা
দুটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক এ এস এম বদরুদ্দোজা, পরিচালক শাজাহান সরকার, নূরুন্নাহার বেগম, শামসুল হক, ব্যবস্থাপক (মান নিয়ন্ত্রক) আয়েশা খাতুন ও ব্যবস্থাপক (উৎপাদন) এমতাজুল হক।
রায়ের দিন মামলায় একমাত্র জামিনে থাকা আসামি ও কোম্পানি পরিচালক শাজাহান সরকার আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বাকি আসামিরা শুরু থেকেই পলাতক। রায়ে শাজাহানের জামিন বাতিল করে সাজা পরোয়ানাসহ কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়। আর পলাতক আসামিরা গ্রেপ্তার হওয়ার অথবা আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে তাঁদের সাজা কার্যকর হবে। তাঁদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।
অপরাধ অনুযায়ী সাজা সামান্যই
১৯৯২ সালে বিসিআই ফার্মার তৈরি ওই ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ 'প্যারাসিটিন' সেবন করায় ৭৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে সারা দেশে প্রায় দুই হাজার ৭০০ শিশু মারা যায় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এত মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেও ওই সব কোম্পানি এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো হত্যা মামলা না হয়ে শুধু ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। এ অবস্থায় বিসিআই ফার্মার কর্মকর্তাদের যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা তাদের অপরাধ অনুযায়ী সামান্যই সেকথা বলছেন মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবীরা। তবে এর জন্য ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনকে যুগোপযুগী না করাকেই দুষছেন তারা।
শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার দাবি
এ রায় প্রসঙ্গে ফৌজদারি মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী আমিনুল গণি টিটো বেনারকে বলেন, “ভেজাল ওষুধ খেয়ে ৭৬ জনের মৃত্যু ঘটে। এত মানুষ মারার পর এ ধরনের শাস্তি খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে। আসামিরা উচ্চ আদালতের কাছ থেকে সহজেই জামিন পেয়ে যাবেন। জাতীয় স্বার্থে ওষুধ নিয়ন্ত্রন আইনটি সংশোধন করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা উচিত।
মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, “এই মামলার সঠিক রায় হয়েছে। কারণ, আইনে যে শাস্তির বিধান আছে সেই শাস্তিই হয়েছে। তবে গলদটা হল ওষুধ নিয়ন্ত্রন আইনে। সরকারের উচিত আইনটি সংশোধন করে এ ধরনের অপরাধকে হত্যা হিসেবে গণ্য করে শাস্তি বিধান করা। তবেই অপরাধীরা যোগ্য সাজা পাবে।”
সন্তুষ্ট নন সরকার পক্ষ
একই সুর শোনা যায় সরকারপক্ষের কণ্ঠেও। “এ রায়ে আমরা আসলে সন্তুষ্ট না হয়ে উপায় নেই। যদিও আসামিদের প্রাপ্ত সাজা অপরাধের তুলনায় অপ্রতুল। ৭৬ জনের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে এ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা উচিত।” বলেন ড্রাগ আদালতের বিশেষ পিপি শাহিন আহমেদ খান।
বাদীর অবহেলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা
মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালের ২ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইনে অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর আসামিপক্ষের আবেদনে হাইকোর্টের এক আদেশে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকে। এছাড়া দীর্ঘদিন বাদী আদালতে হাজির না হওয়ায় এ মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে।
মামলার বাদী ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা (বর্তমান পরিচালক) মো. আবুল খায়ের চৌধুরীকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য গত ২৬ মাসে ১৮টি তারিখে আদালত থেকে সমন পাঠানো হলেও তিনি হাজির হননি। এরপর তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেফতার এড়িয়ে তিনি গত বছরের ৭ আগস্ট আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হলেও মামলা সংশ্লিষ্ট মূল কাগজপত্র সঙ্গে না নেওয়ায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ওই দিন তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। দুটি মামলায় তাঁর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কারাগারে থাকতে হবে বলে তখন আদেশে বলা হয়েছিল। তবে তিন দিন পর তাঁকে জামিন দেওয়া হয়।
কিন্তু কেন তিনি আদালতে হাজির হন নি এবং দায়িত্বে অবহেলা সত্তেও দ্রুত জামিন পেলেন সেইসঙ্গে চাকুরিতে বহাল আছেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।
ঘটনার বৃত্তান্ত:
এসব মামলার আসামিদের সাক্ষ্য ও রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ঢাকা শিশু হাসপাতালে কিডনি বিকল হয়ে শিশুমৃত্যুর হার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক বিগ্রেডিয়ার (অব.) মকবুল হোসেন ১৯৯১ সালের ৩ জুলাই ওষুধ প্রশাসনকে মৌখিকভাবে বিষয়টি অবগত করেন। ওই সময়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনে শিশুমৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। পরের বছর ২৫ নভেম্বর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিদর্শক আবুল খায়ের চৌধুরী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেম ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি থেকে তাদের উৎপাদিত ফ্লামোডল নামক প্যারাসিটামল সিরাপ নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও)ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য পাঠান। একই সময়ে পাঠানো হয় বিসিআই কোম্পানির প্যারাসিটামল ওষুধের নমুনাও।
নমুনা পরীক্ষা শেষে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি জানায়, প্যারাসিটামল তৈরিতে ব্যবহৃত প্রোপাইলিন গ্লাইকলের পরিবর্তে চামড়া শিল্পে ব্যবহৃত ডাই ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহার করা হয়েছে। এসব প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে কিডনি বিকল হয়ে হতভাগ্য ওইসব শিশুদের মৃত্যু হয়েছে।
এরপর আবুল খায়ের চৌধুরী বাদী হয়ে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
বিচারাধীন এ ধরনের আরো তিন মামলা
এটি একই অভিযোগে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়টির রায়। এর আগে গত বছরের ২২ জুলাই অন্য একটি মামলায় অপর ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাডফ্লেম ফার্মাসিউটিক্যালসের তিনজনকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ধরনের আরো তিনটি মামলা বিচারাধীন আছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আবুল খায়ের চৌধুরী জানান, এখনো রিড ফার্মা ও পলিক্যামের বিরুদ্ধে একই ধরনের তিনটি মামলা বিচারাধীন।