প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.01.11
BD-accident ২০১৫ সালে সারাদেশে ছোট বড় ৬ হাজার ৫৮১ সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। মহামারির চেয়ে কোন অংশে কম নয় এ মৃত্যুর হার। শীতের ঘন কুয়াশা যেন এ সংখ্যাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। মহাসড়ক মানেই এখন মৃত্যুপুরী। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি ও উদ্যোগের অভাবেই প্রতিদিন হারাতে হচ্ছে তরতাজা, মেধাবী প্রাণ। গত শনিবারেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২১ জন ব্যক্তি। যাদের মধ্যে রয়েছেন একজন মন্ত্রীপুত্রও।


বঙ্গবন্ধু সেতুতে ভয়বহ দূর্ঘটনায় নিহত ভূমিমন্ত্রীর ছেলে

শনিবার (৯ জানুয়ারি) দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী একমাত্র সেতু বঙ্গবন্ধু সেতুতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয় বেশ কয়েকটি যানবাহন। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন  ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের ছেলে হীরক হাসানুর রহমান শরীফ রানাসহ (৩৯) সাতজন।

জানা যায়, ঘণ কুয়াশায় কারণে একটি যাত্রীবাহী বাস একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এসময় ওই বাসের পেছনে থাকা প্রায়  ২০ থেকে ২৫টি ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস ও ট্রাক একটি আরেকটির ওপর আছড়ে পড়ে। সেসব গাড়িগুলোর মধ্যে একটি প্রাইভেট কারে ছিলেন ভূমিমন্ত্রীর ছেলে। চিকিৎসার কাজে তিনি পাবনা থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। ওই দূর্ঘটনায় অসুস্থ হয়ে পড়লে, তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

বঙ্গবন্ধু সেতুর ওই দূর্ঘটনাকে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এ ছাড়া এদিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন আরো ১৬ জন।

এর আগে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের একমাত্র ছেলে ফাহিমুর রহমান সায়েম (২৫)।


২০১৫ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে ৮,৬৪২ জন

২০১৫ সালে সারাদেশে ছোট বড় ৬ হাজার ৫৮১ সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আর আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। গত শনিবার বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক সংবাদ সম্মেলনে গত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই এসব তথ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করে সংগঠনটি। তাদের হিসাবে, এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালে ৫ হাজার ৯২৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, যাতে মারা যায় ৮ হাজার ৫৮৯ জন এবং আহত হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৫২৪ জন।

দেশের ১০টি জাতীয়, ছয়টি স্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পর্যবেক্ষণ শেষে তৈরি এ প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৮০ জন ছাত্রছাত্রী, ৩শ ৫ জন শিক্ষক, ১শ ৩৩ জন সাংবাদিক, ১শ ৯ জন চিকিৎসক, ১শ ২৪ জন আইনজীবী, ১শ ৬ জন প্রকৌশলী, ৫শ ৩৫ জন পরিবহন শ্রমিক, ৪শ ১৯ জন চালক ও ২শ ৮০ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (পুলিশ, সেনাসদস্য, বিজিবি ও আনসার সদস্য) এবং ২ হাজার ২৪১ জন পথচারী নিহত হয়েছেন।


সড়ক দূর্ঘটনার কারণ

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সড়ক দূর্ঘটনার কিছু কারণ চিহ্নিত করে। এ কারণগুলো হল- ফুটপাত দখল, ওভার টেকিং, ওভার স্পিড ও ওভার লোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তা-ঘাটের নির্মান ক্রটি, গাড়ির ক্রটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ন সড়কের ক্রসিংয়ে জেব্রাক্রসিং না থাকা ও জেব্রাক্রসিং গাড়ি চালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার করা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সাথে চলাচল করা, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন ওঠা।


জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ ক্ষতি

সড়ক দূর্ঘটনার কারণে দেশের জিডিপি’র প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে জানানো হয়। এ বিষয়ে সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী  বলেন, “বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনার নামে ধারাবাহিক হত্যাকান্ড আজ মহামারী আকার ধারণ করেছে। যা ইরাক বা আফগানিস্থানের ভয়াবহ যুদ্ধে যে প্রাণহানি হয়েছে তার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। অত্যন্ত দু:খ জনক হলেও সত্য যে, এ নিরব হত্যাকান্ড প্রতিদিন ঘটলেও এখন দেশের যাত্রী, মালিক, পরিবহন শ্রমিক, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক, সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, সুশীল সমাজ, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে এটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। সবার যেন গা সওয়া হয়ে গেছে এটি”।

তাঁর মতে,  সিংহভাগ সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল প্রাণহানীর সংখ্যা বেশি না হলে বা  গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যক্তি আক্রান্ত না হলে সড়ক দূর্ঘটনার সংবাদ প্রচারে গুরুত্ব পায়না। পুলিশের কাছে সড়ক দূর্ঘটনার বিষয়ে অভিযোগ বা মামলা করে ও ভিকটিম প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা পায় না । সড়ক দূর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তির পাশে দাঁড়ায় না দেশের বিত্তবানরাও।

তিনি আরো বলেন, মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে। এ ক্ষতি দেশের জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ।


পূরণ হয়নি অঙ্গীকার

২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো। নির্ধারিত সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সই করে বাংলাদেশও।  কিন্তু সড়কে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা। পুলিশের দেওয়া হিসেবে, গড়ে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ জন মারা যায়।

তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে মারা গেছে ২৪ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব মূলতঃ সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকলেও বিষয়টি নিয়ে সঠিক কোন কর্মপরিকল্পনা নেই তাদের। কিছু সড়কের বাঁক সোজা করা এবং মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাতেই সীমাবদ্ধ দৃশ্যমান পদক্ষেপ।


চালকহীন ৮ লাখ যানবাহন

সড়ক দূর্ঘটনা রোধে সবচেয়ে জরুরি দক্ষ চালক ও ফিটনেস-সমৃদ্ধ যানবাহন। অথচ বাংলাদেশে এ দুটোরই সংকট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি বাণিজ্যিক যানবাহনে দুজন চালক আবশ্যক হলেও বাংলাদেশে যানবাহন প্রতি একজন করে চালকও নেই। দেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের বিপরীতে চালকের লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ১৫ লাখ। সেই হিসেবে এদেশে চালকহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় আট লাখের মত।

অভিযোগ রয়েছে, যথাযথ পরীক্ষা না নিয়েই শুধুমাত্র শ্রমিক ইউনিয়নের দেওয়া তালিকা ধরে এই লাইসেন্স দেওয়া হয়। ২৩ লাখের মধ্যে ফিটনেস নেই ৩ লাখের বেশি যানবাহনের। এক্ষেত্রেও যথাযথ নিরীক্ষা ছাড়াই ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার কথা থাকলে ও বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) খালি চোখে এক নজর দেখেই তা দিয়ে দেয়। সরকারের স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেওয়ার যন্ত্রটি প্রায় ১২ বছর ধরেই নষ্ট পড়ে রয়েছে।


দূর্ঘটনা রোধে ১০ দফা সুপারিশ

দেশে সড়ক দূর্ঘটনা রোধে ১০ দফা সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এগুলো হলো-ট্রাফিক আইন ও মোটরযান আইন সম্পর্কে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের, মসজিদ, মন্দির, গির্জায় ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করা। টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র সমূহে সড়ক দূর্ঘটনা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা।

এতে বলা হয়,  জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ করা, ফুটপাত দখল মুক্ত করা। রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রাক্রসিং অংকন করা। চালকদের প্রফেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। চালকদের বিশ্রাম ও কর্ম বিরতির সুযোগ দেওয়া। বিদ্যমান মোটরযান আইন যুগোপযোগী করা এবং গাড়ীর ফিটনেস প্রদান পদ্ধতি ডিজিটাল করা।

সুপারিশে আরো বলা হয়, সড়ক দূর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে যারা ছিন্নমূল ও দারিদ্রের কাতারে নেমে যাচ্ছে তাদের ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেন এর ব্যবস্থা করা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত ট্রমা সেন্টারগুলো দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করা।


চাই সঠিক নীতি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক বেনারকে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সঠিক নীতি ও সাশ্রয়ী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বছরের শুরতেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দেশে যেসকল মহাসড়কে নিয়মিত সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে, সেসব সড়ক চিহ্নিত করে প্রয়োজণীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল- চালকদের দক্ষ করে তোলা। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার কারণ ও এর ক্ষয়ক্ষতি  সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।