বাংলাদেশের গণমাধ্যম চাপের মুখে, মত প্রকাশের সুযোগ সীমিতঃ অ্যামনেস্টির রিপোর্ট
2016.02.23

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যখন হই চই চলছে, তখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, দেশটির গণমাধ্যম মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। ওই সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীন গণমাধ্যমকে চাপে রেখে মত প্রকাশের সুযোগ সীমিত করা হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার অ্যামনেস্টির মানবাধিকার বিষয়ক এই বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। লন্ডনে অ্যামনেস্টির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ২০১৫ সালে মানবাধিকারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।
সরকারের সমালোচনা ও গণমাধ্যমের চাপ
বাংলাদেশে মত প্রকাশে স্বাধীনতার পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সমালোচনা করা স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা হয়, গত অক্টোবর মাসে সরকার কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা যেন দেশের শীর্ষ দুটি দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন না দেয় এবং বিজ্ঞাপন দিলে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পত্রিকা দুটি সমালোচনামূলক অবস্থানের জন্য পরিচিত।
উল্লেখ্য, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের প্রায় ৭৯টি মামলা হয়েছে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে অর্ধশতাধিক মামলা।
“কোন কোন প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন দিতে নিষেধ করা হয়েছে, সেটির নাম অ্যামনেস্টি পারলে প্রকাশ করুক। এই দুটি জনপ্রিয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞাপন পাচ্ছে,” বেনারকে জানান প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, যিনি একজন সাংবাদিক নেতা।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে বিজ্ঞাপন না দেওয়ার বিষয়ে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশ নেই বলেও জানান তথ্য উপদেষ্টা।
যদিও ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দেশের বেশ কয়েকটি বড় শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন দিতে সরকারের একটি মহল বাঁধা দিচ্ছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো।
মত প্রকাশে আরও অন্তরায়
গণমাধ্যমের চাপ ছাড়াও মত প্রকাশে আরও কিছু অন্তরায়ের উদাহরণ তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, সংসদের সমালোচনা করায় গত নভেম্বরে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করে।
এ ছাড়া বিচার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করায় ঢাকার একটি আদালত সুশীল সমাজের ৪৯ জনের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে, যা মত প্রকাশের অন্তরায়।
গত বছর ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা এবং সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার ঘটনা মত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ব্লগারেরা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ মত প্রকাশ করায় ইসলামি জঙ্গিদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে অভিজিৎ রায়কে হত্যা এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে হত্যার চেষ্টা হলেও তাঁর বেঁচে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া প্রতিবেদনে তিন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান, নিলয় নীল ও অনন্ত বিজয় দাসের হত্যাকান্ড, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা এবং অপর দুই লেখককে হত্যার চেষ্টা হলেও তাঁদের বেঁচে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারি কর্তৃপক্ষ লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য ব্লগার ও প্রকাশকদের অভিযুক্ত করে।
“মত প্রকাশে সরকার কাউকে হস্তক্ষেপ করে না। এটা করলে সরকারবিরোধী প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশ হচ্ছে কীভাবে? বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে টক শো কীভাবে চলছে?” প্রশ্ন রাখেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ
অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গত বছর পর্যন্ত এমন ১৬ জন অভিযুক্ত হয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ব্যক্তি বলে পরিচিত হলেও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ–সংক্রান্ত দালিলিক তথ্যপ্রমাণ থাকলেও সরকার তা আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ তুলেছে সংস্থাটি।
“মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ করে থাকলে অ্যামনেস্টি তা প্রকাশ করুক,” বেনারকে জানান একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
তিনি বলেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বা স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি, তিনি কেন মানবতাবিরোধী অপরাধ করবেন? অ্যামনেস্টির এমন বক্তব্য নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক।
পেট্রল বোমা ও বিরোধীদের গ্রেপ্তার
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত সরকার বিরোধী আন্দোলনে যাত্রীবাহী বাস ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রল বোমা হামলা হয়। এতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন।
এসব ঘটনার জের ধরে শত শত বিরোধী নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে অ্যামনেস্টি জানায়, “সরাসরি হামলায় জড়িত কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।”
যদিও বাংলাদেশ পুলিশ দাবি করেছে, ওই সব ঘটনায় জড়িতদের বিচার চলছে।
গুম ও খুন
গুম সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নাগরিকদের গ্রেপ্তার করেছে এবং পরবর্তীতে ওই সব ব্যক্তির অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানে না বলে অস্বীকার করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান তুলে ধরে অ্যামনেস্টি বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুজন নারীসহ কমপক্ষে ৪৩ জন গুম হয়েছেন। এদের মধ্যে ছয়জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, চারজনকে অপহরণের পর মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং পাঁচজনকে পুলিশ হেফাজতে পাওয়া গেছে। তবে বাকি ২৮ জনের ভাগ্য এখনো অজানা থেকে গেছে।
এতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও সাত খুনের দায়ে তিনজন র্যাব সদস্যের বিচার চললেও অন্য কোনো গুমের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও কষ্টদায়ক আচরণের ব্যাপক মাত্রায় অভিযোগ থাকলেও এসব অভিযোগের তদন্ত হতে খুব একটা শোনা যায় না।
উল্টো গত বছরের মার্চ মাসে পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা নির্যাতনের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেতে প্রকাশ্যে আইনি সুরক্ষার দাবি তোলেন।
বছরের শেষ দিকে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা ও সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনাও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
ভারত ও আফগানিস্তানে অগ্রগতি
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন বন্ধে আফগানিস্তান ও ভারতের সরকার ইতিবাচক দিকে হাঁটছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, হাজতে বন্দীদের নির্যাতন বন্ধে আফগান সরকার একটি জাতীয় কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে।
আর ভারতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট প্রতিটি হাজতে সিসিটিভি বসানোর আদেশ দিয়েছে। এ ছাড়া ভারত সরকারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে প্যানেল কোর্টের বিধি সংশোধনে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।
তবে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ছাড়া, গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ২৪০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্ষণের ঘটনা বাড়তির দিকে থাকলেও এর বিচার হওয়ার হার খুবই কম।
মৃত্যুদণ্ড বাড়ছে
অ্যামনেস্টি যে কোনো মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ কমিয়ে আনা হচ্ছে।
রাজন হত্যার ছয় আসামি ও বাবা-মাকে হত্যাকারী ঐশী রহমানসহ ২০১৫ সালে বাংলাদেশে মোট ১৯৮ জন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে এগিয়ে পাকিস্তান। দেশটি গত বছর তিন শতাধিক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থাগুলোই ঝুঁকিতে
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে দেশে সংঘাত ও শরণার্থী সংকট, ক্ষমতাসীনদের কর্তৃক ভিন্নমত দমনে বলপ্রয়োগের ঘটনা প্রমাণ করেছে যে, মানবাধিকার রক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদ্যমান আন্তর্জাতিক পদ্ধতি যথেষ্ট নয়।
উল্টো মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থাগুলোই ঝুঁকিতে রয়েছে। যেকারণে সংগঠনটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষা ব্যবস্থার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতি নবায়নের আহ্বান জানিয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও আশ্রয়ের খোঁজে সাগর পাড়ি দেওয়া শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা উল্লেখ করেছে অ্যামনেষ্টি।
সংস্থাটি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ না হওয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দেশগুলোর অবিবেচনামূলক ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগকে দায়ী করেছে।