শেষ পর্যন্ত দপ্তর হারালেন প্রভাবশালী নেতা সৈয়দ আশরাফ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.09
BD-ashraf দপ্তর হারানোর পরও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দলীয় কার্যালয়ে যুবলীগের ইফতার পার্টিতে যান এবং বক্তব্য রাখেন। ৮ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে। গত মঙ্গলবার থেকে এ নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন চললেও সৈয়দ আশরাফই গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিষয়টি গুজব।  

ওই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেয়াই। তিনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। এটি হবে তাঁর অতিরিক্ত দায়িত্ব।

সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতি দেওয়ায় দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নব্বই পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলের সাধারণ সম্পাদক বা মহাসচিবই আর্থিক বা দলীয় বিবেচনায় এই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।    

গত ৭ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে ওই দিন নাটকীয় অবস্থা চললেও সন্ধ্যার দিকে সৈয়দ আশরাফ বিষয়টিকে গুজব বলে এতে কান না দেওয়ার পরামর্শ দেন।


দপ্তর হারালেও মন্ত্রী থাকছেন, থাকছেন দলীয় পদেও

৯ জুলাই দুপুরে সৈয়দ আশরাফকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তাঁরা দীর্ঘ সময় একান্তে কথা বলেন। সূত্র জানায়, এ সময় প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রস্তাব তিনি মেনে নেন। তবে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবেই তিনি থাকছেন।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয় থেকে অব্যাহতি পেলেও ৯ জুলাই তিনি যুবলীগের ইফতার মাহফিলে অংশ নেন। তবে সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান তিনি।

দলের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও তিনি থাকবেন। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে।

“এটা তো আর বিএনপি বা জাতীয় পার্টির মতো দল নয়। সাধারণ সম্পাদক পরিবর্তন করতে হলে কাউন্সিলের মাধ্যমেই হবে,” বেনারকে জানান ওবায়দুল কাদের, যিনি সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।   

সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার একনেকের সভায় অনুপস্থিত থাকায় সৈয়দ আশরাফকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। বেশ কিছুদিন ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।

এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে তাঁর না যাওয়া, সরকার ও দলের অনুষ্ঠানে মাঝেমধ্যে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও দলের ভেতর সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তিনি। এ ছাড়া সরকার ও দলের নিচু থেকে উঁচু স্তরের নেতারাও তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।  

আপাতদৃষ্টিতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত অভিযোগ ছিল, তিনি মন্ত্রণালয়ে যান না। কিন্তু ওই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ সময়মতো হয়নি, কিংবা কাজে দুর্নীতি বা অনিয়ম হয়েছে-এমন ব্যক্তিগত অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে নেই।

দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ না নেওয়া এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সারা দেশে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ, পরামর্শ ও দল পরিচালনায় তাঁর এক ধরনের নিষ্পৃহতা ছিল বলে অভিযোগ নতুন নয়। এই অভিযোগের ভিত্তি থাকলেও দলের পদ থেকে তাঁকে সরানো হয়নি।  


মতভিন্নতার কারণে দুরত্ব সৃষ্টি

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সরকার যে প্রক্রিয়ায় বা পদ্ধতিতে চলে তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর ভিন্নমত ছিল। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তাঁর মন্ত্রণালয়ে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার যে বিশাল প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়, ওই প্রকল্প নেওয়ার বিষয়েও তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।  

বিভিন্ন সময়ে এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সংস্থায় শীর্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ, ওই সব পদে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর অনেকগুলোই হয়েছে তার অমতে।

ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গত ২৮ এপ্রিলের নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে সরকারের নির্দেশনাও গিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে। এটি পদ্ধতিগতভাবে সঠিক না হওয়ায় আগের প্রস্তাব ফেরত এনে নতুন করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। এ রকম আরও কিছু পদ্ধতিগত ও প্রক্রিয়াগত বিষয়ে সরকারের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেন, মন্ত্রণালয় ও দলে সৈয়দ আশরাফের কর্মকাণ্ড প্রধানমন্ত্রী একপ্রকার মেনেই নিয়েছিলেন। নইলে গত প্রায় সাড়ে ছয় বছর কীভাবে থাকলেন? তবে মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সৈয়দ আশরাফের অবস্থান মন্ত্রণালয়ে দুর্বল হতে থাকে।


অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অবস্থান নিলেন

সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে চলমান মতবিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মঙ্গলবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি বক্তব্যে। একনেক সভায় তিনি বলেন, ‘ছয় হাজার কোটি টাকার এত বড় প্রকল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দুজন মন্ত্রী রয়েছেন, একজনও আসেননি। তাই এ প্রকল্প একনেক সভা থেকে প্রত্যাহার করা হোক। তাঁদের মতামত নিয়ে প্রকল্পটি পাস করা দরকার’।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঠিক আছে, মনে করেন আমিই মন্ত্রী। প্রকল্পটা প্রত্যাহার করবেন না।’  এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘ঠিক আছে, উনি যখন মিটিংয়ে আসেন না, আমি উনাকে সরিয়ে (চেঞ্জ করে) দিচ্ছি। এখানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আছেন, আজকেই চেঞ্জ করতে বলব।’  

কিন্তু ওই দিন পরিবর্তন না করলেও একদিন পর তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। তবে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞাকে ওই দিনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন বলে সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।

“সচিব হিসেবে আমার কাজ সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন করা। এর বাইরে কোনো বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই,: বেনারকে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন।

একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনের পদত্যাগের সঙ্গে এই ঘটনার মিল পাওয়া যায়। তাঁর মতে, সৈয়দ আশরাফ প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং এক-এগারো সরকারের সময়ে দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।  


প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ইঞ্জিনিয়ার মোশারফের কৃতজ্ঞতা

“আমার প্রথম ও প্রধান কাজ হবে প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী কর্মসূচি “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প” বাস্তবায়নের মাধ্যমে পল্লি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা,” গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ফরিদপুর শহরতলির বদরপুর এলাকার নিজ বাড়ি আফসানা মঞ্জিলে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব কথা বলেন।   

প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তাঁর বেয়াই খন্দকার মোশাররফ। তিনি বলেন, সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন।

খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘আমার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল এই মন্ত্রণালয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে এই শেষ জীবনে আরও কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।’  



কিশোরগঞ্জবাসী ক্ষুব্ধ, ‘তিনি সাধারন জীবন-যাপন করতেন’

এদিকে সৈয়দ আশরাফকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অপসারণ করায় ক্ষুব্ধ কিশোরগঞ্জবাসী।“সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরতো হাত নেই। তবে আমাদের নেতা মন্ত্রী নেই ভাবতে খারাপ লাগছে,”টেলিফোনে বেনারকে জানান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ আফজাল।

সৈয়দ আশরাফ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেবার পর কিশোরগঞ্জের চেহারায় পরিবর্তন আসে। সড়কে সোডিয়াম বাতি সংযোজন করে কিশোরগঞ্জকে আলো ঝলমলে সড়কে পরিণত করা হয়। এ ছাড়া নরসুন্দা নদ খনন প্রকল্পসহ শতকোটি টাকার কাজ চলমান। মন্ত্রীত্ব না থাকায় এইসব প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।  

“সৈয়দ আশরাফ ছিলেন তরুণদের আদর্শ। তাঁর বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এরপরও তিনি অতি সাধারণের মতোই জীবন যাপন করে আসছিলেন,” বেনারকে জানান গুরুদয়াল সরকারি কলেজের একাদশ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তানভির আহমেদ।

তাঁর মতে, “আমাদের দেশে মন্ত্রী হতে পারলেই রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়া রীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ তিনি কিশোরগঞ্জ এসে চাচার বাড়িতে ওঠেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।