গভর্নরের পদত্যাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজিরবিহীন পরিবর্তন

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.03.15
BD-atiur বাংলাদেশ ব্যংকের গভর্নর হিসেবে পদত্যাগের পর নিজ বাসভবনে আতিউর রহমান সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য রাখেন। ১৫ মার্চ,২০১৬
ফোকাস বাংলা

রিজার্ভের অর্থ চুরির ঘটনার প্রেক্ষিতে গভর্নরের পদত্যাগ, নতুন গভর্নর নিয়োগ থেকে শুরু করে নজিরবিহীন পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলাদেশে ব্যাংকে। পাশাপাশি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও আর্থিক বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে। ‘পরিবর্তন আসছে’ অর্থমন্ত্রীর এমন ইঙ্গিতের পরদিন সকাল থেকেই ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ চুরির মতই নজিরবিহীন একদিনের ব্যবধানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এত পরিবর্তনও।

তবে একমাস আগে ঘটে যাওয়া চুরির ঘটনা সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানানোয় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আতিউর রহমানের উপর অর্থমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্যদের ক্ষোভ এ পরিবর্তনের আভাস দিয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সে পরিবর্তনের শুরুটা করেন আতিউর রহমান। দিনের সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত পাওয়া যায় আরো কিছু রদবদলের খবর।


সমালোচনার মুখে পদত্যাগ আতিউরের

‘হাওয়া’ প্রতিকূলে যাচ্ছিল ভারত সফরে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর (সদ্য সাবেক হওয়া) আতিউর রহমান সেটা আঁচ করেছিলেন হয়ত। সেটা আরো নিশ্চিত হন দেশে ফেরার পরেই অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে। মঙ্গলবার সকালে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তিনি (আতিউর) চলে গেলে ভালো চলবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর অপেক্ষায় ছিলেন বলে জানান।
এরপর বেলা গড়ায়। সকাল সোয়া ১১টার দিকে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী সেটা গ্রহণ করেন।


সৎ সাহসের পরিচয় মন্তব্য প্রধানমন্ত্রীর

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করায় আতিউর রহমানের প্রসংশা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।  এটাকে তার  ‘সৎ সাহসের’ পরিচয় বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার পাশাপাশি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যান্য দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- আতিউর রহমানের এই পদত্যাগ একটি সাহসী পদক্ষেপ, যা নৈতিক মনোবল ও সৎ সাহসের বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।”

এসময় প্রধানমন্ত্রী গত সাত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তার ভূমিকার কথাও তুলে ধরেন। বিশেষ করে তার দায়িত্বকালীন  সময়ে রিজার্ভ বৃদ্ধি ও ব্যাংকিং সেবাখাত আরও গতিশীল  হওয়ার কথা স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।


চুরির ঘটনা শুনে ভয় পেয়েছিলাম - বিদায় বেলায় বললেন আতিউর

সকালে পদত্যাগের পরপরই গণমাধ্যমে কোন কথা না বললেও বিকেলে নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরের দায়িত্ব পালন করা আতিউর রহমান। সেখানে তিনি জানান চুরির ঘটনা শুনে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

আতিউর রহমান রিজার্ভ চুরিরকে দূর্ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, এটা অনেকটা জঙ্গি আক্রমণের মতো, অনেকটা ভূমিকম্পের মতো। কোন দিক থেকে এসেছে, কে করেছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। শোনার পর আমি ‘পাজলড’ ছিলাম। এটা আমাদের সমস্ত অর্থনীতিকে যেন ভেঙে না ফেলে সেই ভয়ে বিদেশ থেকে  তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে তাদের মতামত নিয়েছি। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো সিকিউরিটি নিশ্চিত করেছি, যাতে ভবিষ্যতে আর ক্ষতি না হয়। পাশাপাশি কোথা থেকে কেমন করে এই ঘটনার উৎপত্তি ঘটল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। দেশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোকে সঙ্গে নিয়েছি।

প্রথম দিনই এফআইইউয়ে (ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এফআইআর করেছি এবং তাদের পরামর্শমতো কাজ শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েছি। ফিলিপিন্সের গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছি। যেহেতু ইন্টেলিজেন্সের বিষয়- এগুলো গোপনীয়তার সাথে করতে হয়।

দায়িত্বপালন কালে চারগুন বাড়ানো রিজার্ভকে সন্তানের মতো আখ্যা দিয়ে –এর একটি ডলারও নষ্ট হোক আমি চাইনি বলে জানান তিনি।

একইসঙ্গে একটা অংশ ফেরত এসেছে জানিয়ে ফিলিপাইন থেকে পুরোটাই ফেরত পাওয়ার আশাও শোনান তিনি।

সদ্য পদত্যাগী গভর্ণর বলেন, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। গোটা ব্যাপারটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি, পরে চিঠি লিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছি।

তবে এসব পদক্ষেপ নিতে সময় লাগার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, একটু সময় লেগেছে আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু এই সময়টা আমি নিয়েছি দেশের স্বার্থে। এই অর্থগুলো যেন নিশ্চিতভাবে দেশে ফেরত আনা যায় তার স্বার্থে এবং বড় রকম আর কোনো সংকট আছে কি না তা দূর করার স্বার্থে।

এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। এটা একটা সাইবার অ্যাটাক। কোথা থেকে এটা এসেছে তা আজও আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। র‌্যাবকে বলেছি, ভেতরে কেউ যদি এতে জড়িত থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। ভবিষ্যতে যাতে করে এ রকম না ঘটে সেজন্য এ লাইনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যারা তাদের যুক্ত করেছি ফায়ারওয়াল দিচ্ছি। শুধু তাই না, ব্যাংকগুলোকেও ফায়ারওয়াল সৃষ্টির নির্দেশনা দিয়েছি।”

তিনি বলেন, ‘একেকটা চ্যালেঞ্জ এসেছে, আমরা মুখোমুখি হয়েছি এবং এগিয়ে যেতে পেরেছি। আমি যখন চলে যাচ্ছি, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে স্থিতিশীল অবস্থায়।’


নতুন গভর্ণর ফজলে কবির

আতিউর রহমানের পদত্যাগের মাত্র দুঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরের নাম ঘোষণা করে সরকার। সাবেক অর্থ সচিব ফজলে কবিরকে বিদায়ী আতিউর রহমানের স্থলাভিষিক্ত করার কথা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এখন তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান।

মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে গভর্নর করা হয়েছে।”
বর্তমানে নিউইয়র্ক সফরে থাকা ফজলে কবির আগামী শুক্রবার (১৮ মার্চ)দেশে ফিরবেন। জানা যায়, ২০১২ সালে অর্থ সচিবের দায়িত্বে আসেন তিনি। এর আগে জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। এছাড়া জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও ছিলেন সাবেক আমলা ফজলে কবির।


সঙ্গে আরো কিছু রদবদল

আতিউর রহমানের পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুইজন ডেপুটি গভর্নরকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরা হলেন আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানা। অর্থমন্ত্রী জানান, এই দুই পদে শিগগিরই নতুন নিয়োগ হবে। গভর্নর ও দুই ডেপুটি গভর্নরের অব্যাহতির পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এখন দুজন ডেপুটি গভর্নর দায়িত্ব পালন করছেন।

এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুজন নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও দুজন মহাব্যবস্থাপককে (জিএম) অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে ব্যাংকের বিধি অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা কেবল গভর্নরের থাকায়, নতুন গভর্নর যোগদানের পর তাদের বিষয়টি কার্যকর হবে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।