এক ফটো সাংবাদিক অভিজিতের জীবন বাঁচাতে গিয়ে বিপদে পড়েছিলেন
2016.02.25
ব্লগার অভিজিৎ ও বন্যা দুর্বৃত্তদের চাপাতির আঘাতে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে মানবিক কর্তব্যে সাড়া দিতে গিয়ে ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদ তাদেরকে সেদিন হাসপাতালে নিয়ে যান , আর এরজন্য চাকুরী হারান, সহকর্মিরা এড়িয়ে চলেন ও পুলিশের হয়রানীর শিকার হন। সেইসঙ্গে বেকার হয়ে অর্থ সংকটে পড়ে ক্যামেরা বিক্রি করতে বাধ্য হন।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা চলাকালে অভিজিতের হত্যা ও বন্যার মারাত্নক আহত হওয়া অবস্থায় তাদের রক্ত যেন আজো জীবন আহমেদ তার নিজের হাতে অনুভব করেন।
আহমেদ বলেন, “ আমি আগে জানতাম না মানুষের রক্ত এত উষ্ণ থাকে, আমি এখনো সেই উত্তাপ অনুভব করি”।
আহমেদ এখন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার বেনার নিউজকে বলেন, “আমি এখনো একবছর আগের ঘটনা মনে করতে পারি। আমার মাথা আজো ভার হয়ে থাকে সেদিনের নৃশংস ঘটনা মনে আসলে। আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না। এখন তাই আমি দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে থাকি”। জানালেন সেদিন পুলিশ সহ শত শত মানুষ রায়ের উপর হামলার ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখছিলো আর বন্যা তাদেরকে বাঁচার জন্য চিৎকার করছিলো।
এই লেখক দম্পতি বইমেলায় অংশ নিতে ঢাকায় এসেছিলেন, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে বুদ্ধিজীবী লেখকরা প্রতিবছর যোগ দিতে আসেন। মেলা থেকে সন্ধার পর বাসায় ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রিক্সা যোগে পার হচ্ছিলেন। ইসলামি জঙ্গিরা তাদেরকে সেখানে থামিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আক্রমন চালায়।
অভিজিৎ একজন ইঞ্জিনিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও মুক্ত মনার ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর এই ব্লগে ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো।
ঘটনার দিন একটি ফটো এজেন্সি জীবনকে বই মেলার ছবি তুলতে পাঠায়। তিনি ঘটনাস্থল থেকে অল্প কিছু দূরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন।
চিৎকারের আওয়াজ
জীবন বলছিলেন, “হঠাত সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এক মহিলার চিৎকার শুনতে পাই, তৎক্ষণাৎ সেখানে ছুটে যাই, গিয়ে দেখালাম মহিলাটি পার্ক করা একটা মটর সাইকেলের উপর শুয়ে তার মাথাটি মাটিতে”।
“তাকে দুইবার ঝাকি দেই, তৃতীয় বারে তিনি সাড়া দেন”। জীবন বলছিলেন আরো, “তিনি আমার দিকে ভায়ার্ত চোখে তাকাচ্ছিলেন, তিনি ভাবছিলেন আমি একজন আক্রমনকারী”।
তিনি তাকে সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা বললেন। বন্যা জিজ্ঞেশ করলো, “এখানে কী হচ্ছে?”
কয়েক গজ দূরে আরেকজনকে ঘিড়ে আছে মানুষজন। বন্যা সেখানে এগিয়ে গেলো “অভি, অভি” (তখনো জীবিত) ডাকতে ডাকতে। সে অভিকে জড়িয়ে ধরলো এবং উঠানোর চেষ্টা করছিলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো।
জীবন তখন তার ক্যামেরায় বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললো। রক্তাক্ত বন্যা তখন তাদেরকে সাহায্য করতে বললো।
জীবন আরও জানায়, সে একটা ৩ চাকার সিএনজি থামিয়ে অভিজিতকে ও বন্যাকে বসিয়ে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যায়। বন্যা তখন তার স্বামীর শরীর জড়িয়ে বসে ছিলো। অভিজিতের মাথাটা সে ধরে রাখে।
“ হঠাত দেখি যে চাপাতির আঘাতে কেটে যাওয়া মাথায় তার মগজ আমার হাতে লেগে যায়। আমি আঙ্গুল সড়িয়ে নেই। আস্তে করে তার মাথা থেকে বেরিয়ে আসা মগজ ভেতরে ঠেলে দেই”।
ঘটনাস্থল থেকে সিএনজি হাসপাতালের দিকে যাবার সময় বন্যা ভয় পেয়ে ভাবছিলো আমি তাদেরকে আটকে বন্দি করতে যাচ্ছি।
“সে আমাকে বলছিলো তাদেরকে ছেড়ে দিতে বিনিময়ে টাকা যত লাগে দিবে। আমি ক্যামেরাটা উচু করে ধরে বার বার বলি আমি ফটো সাংবাদিক আমি আক্রমনকারী কেউ না। কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করছিলো না”।
পুলিশ চেক পোস্টের কাছে রাস্তা জ্যাম হয়ে গেলে গাড়ি থেমে যায়। “ পুলিশ দেখা মাত্র বন্যা চিৎকার করে সাহায্য চাইছিলো এবং বলছিলো আমি তাদেরকে আটক করেছি। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে আমাকে এবার পুলিশের লাঞ্চনার শিকার হতে হবে”।
“হঠাত দেখলাম যে, আমাদের পিছন পিছন একটা পুলিশ আসছিলো সে শুরু থেকে সব দেখেছে, সে এসে পড়ায় চেক পোস্ট খুলে দেয়া হলো এবং তাদেরকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাই”।
সাংবাদিকতার রীতি ভঙ্গের প্রশ্ন
ঢাকা মেডিকেলে আসার পর আমার ফটো সাংবাদিক বন্ধুরা বলতে শুরু করলো আমি সাংবাদিকতার রীতি ভঙ্গ করে তাদেরকে নিয়ে এসেছি।
তারা বলছিলো, আমার উচিত হয় নাই তাদেরকে নিয়ে আসা। এখন পুলিশের ঝামেলায় আমাকে পড়তে হবে, জানালো তারা। তাদের অনেকে দূরে সরে গেলো।
হাসপাতালে রক্ত মাখা টি-শার্ট পরিস্কার করে সেদিন জীবন মতিঝিলে তার অফিসে ফিরে আসে। ‘অফিসে এসেই টিভিতে দেখতে পাই তারা দুজন অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদ, আগে তাদেরকে চিনতাম না’।
অফিসের বস তাকে জানালো কোথাও পালিয়ে যেতে এবং অফিস থেকে দূরে চলে যেতে। ‘আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়, ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো, কিন্তু পরে ঠিক করলাম আমি কোথাও পালিয়ে যাব না’।
তার তোলা ছবিগুলো দ্রুত ছড়িয়ে গেলো ফেসবুকে। ‘সেখানে শত শত কমেন্ট আসলো, কেন আমি তাদেরকে সাহায্য না করে ছবি তুলছিলাম’।
এরমধ্যে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাশা করতে শুরু করলো। অন্তত ৫ দফা কথা বলেছে।
কেউ খোঁজ নিলো না
জীবন বলছিলো, সে তার চাকরী হারালো। তার কোনো আত্নীয় নেই ঢাকায়। খুলনা থেকে এসেছে। টাকার অভাবে ক্যামেরা বিক্রি করতে বাধ্য হলো।
তবে সে অবশেষে স্বস্তি পেলো, বন্যা নিশ্চিত করেছে পুলিশকে যে সে হত্যাকারী নয়, সে ছিলো সেদিন উদ্ধারকারী।
বেনারকে জীবন জানায়, “আমি এখনো একবছর আগের ঘটনা মনে করতে পারি। আমার মাথা আজো ভার হয়ে থাকে সেদিনের নৃশংস ঘটনা মনে আসলে। আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারি না। এখন তাই আমি দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে থাকি”।
জীবন এখন ফ্রি-ল্যান্স ফটোগ্রাফার। সে ঠিক করেছে অভিজিৎ হত্যা নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে আর কোনো কথা বলবে না। তার কস্ট, কেউ তার খোঁজ নেয় নাই। সেদিন কি হয়েছিলো জানতে চায় নাই, একবছর পরে এসব বলে আর কি হবে? প্রশ্ন রাখে সে।