প্রবাসী এক ব্লগারকে হত্যার হুমকি, নিরাপত্তা দিচ্ছে জার্মান পুলিশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.28
BD-blogger জার্মান প্রবাসী ব্লগার ওমর ফারুক লুক্সকে তার লেখালেখির জন্য হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। জুলাই,২০১৫
ইন্টারনেট

জার্মান প্রবাসী ব্লগার ওমর ফারুক লুক্সকে সেদেশে গিয়েই হত্যার হুমকি দিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মো. শফিকুল ইসলাম। শফিকুল বৃত্তি নিয়ে জার্মানীতে পড়াশোনা করতে গেছেন। জার্মান পুলিশ লুক্সকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে, এ খবর এসেছে আন্তর্জাতিক কয়েকটি মিডিয়ায়।

মুক্তমনা ব্লগার লুক্স পেশায় একজন ভাস্কর এবং পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে।

ওমর ফারুক লুক্স অভিযোগ করেন, শফিকুল বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে তাকে মেসেজের মাধ্যমে হুমকি দিয়ে আসছিলেন।

“আনসারুল্লাহ দলের সদস্যরা বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনের মৌলবাদীদের সহায়তায় জার্মানিতে আমার ও আমার স্ত্রীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং অনলাইনে বিভিন্নভাবে আমাদের অনুসরণ করছে,” লিখিত অভিযোগে বলেছেন লুক্স।

স্ত্রী ও ব্লগার ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধাকে নিয়ে লুক্স বার্লিনে প্রায় ৪ বছর ধরে বসবাস করছেন এবং দুজনই সেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।

লুক্স এবং তাঁর স্ত্রীকে এ বিষয়ে  সতর্ক করেছে জার্মান পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে বাসা বদলেরও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন তাঁরা।

বাংলাদেশে লুক্সের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এমন একজন সাংবাদিক একুশ পাপাদার বেনারকে বলেন, “লুক্সের সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে তাতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী শঙ্কার মধ্যে আছেন। তাঁরা এখন সেখানে সার্বক্ষণিক পুলিশ পাহারায় থাকছেন।”  


শফিকুলকে ঘিরে সন্দেহ

২০১৪ সালের ৩ জুলাই শফিকুল লুক্সকে ফেসবুক বার্তায় লেখেন বুয়েট থেকে স্কলারশিপ পাওয়া খুব সহজ, স্কলারশিপ নিয়ে ওদেশে গিয়েই তিনি লুক্সকে 'সাইজ' করবেন। লুক্সকে সীমা লংঘনকারী উল্লেখ্য করে শফিকুল লেখেন, “তোর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে।”

লুক্স জানান, গত ফেব্রুয়ারিতে শফিকুল জার্মানি গিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে নিজের ফেসবুকে লুক্সকে ব্লক করে দেন। বর্তমানে শফিকুলের ফেসবুক আইডিও নিষ্ক্রিয় (ডিএক্টিভেটেড) করে রাখা আছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শফিকুল বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের নবম ব্যাচের ছাত্র। তার ক্রমিক নম্বর ২৬।

এদিকে শফিকুলের হুমকি এবং জঙ্গিদের তৎপরতার কথা উল্লেখ করে ঢাকায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এবং ঢাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সব দূতাবাসের কাছে ই-মেইল করেন লুক্স।

জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “এমন কোনও অভিযোগ পাওয়ার কথা তিনি মনে করতে পারছেন না।”

তবে অভিযোগ সম্বলিত মেইলের জবাবও লুক্স পাননি।

নিজের ফেসবুকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে লুক্স বলেছেন, “আপনাদেরকে একজন শিক্ষিত মৌলবাদী সন্ত্রাসীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এই হুজুরের নাম শফিকুল ইসলাম। ইনি একজন বুয়েট ছাত্র। আমি আজ পর্যন্ত ইনবক্সে যত হত্যার হুমকি পেয়েছি, তার মধ্যে এই ভদ্রলোকের কাছ থেকেই পেয়েছি সবচেয়ে বেশি।”
ওই বক্তব্যের সঙ্গে শফিকুলের ছবিও প্রকাশ করেছেন লুক্স।

জার্মানিতে অবস্থানরত শফিকুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

লুক্স যেসব স্ট্যাটাস দিয়েছেন

লুক্সের ফেসবুক আইডি ও ব্লগে ঢুকে দেখা যায়, তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে এবং কোরাণ বিরোধী বেশ কিছু স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এসব স্ট্যাটাস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।

বিভিন্নজনের মতামত সম্পর্কে লুক্স লিখেছেন, “বিশ্বাস করুন, লেখালেখি শুরু করার পর থেকে যত ম্যাসেজ পেয়েছি, তা অশিক্ষিতদের কাছ থেকে নয়, সব উচ্চ শিক্ষিতদের কাছ থেকে। ডাক্তার, ইন্জিনিয়র, প্রফেসর, এমনকি সচিব আর সরকারের বড় বড় কর্মকর্তাদের কাছ থেকেও। আর এ হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা।”

লুক্সের ফেসবুক ও ব্লগে এমন অনেক মন্তব্য রয়েছে ইসলাম ধর্ম, নারী ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু ছাত্র ও কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিযবুত তাহরির এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

“প্রকৌশল বিদ্যার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বুয়েটে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর এমন তৎপরতায় আমরা হতাশ ও উদ্বিগ্ন,” জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের একজন অধ্যাপক।


৪ ব্লগার খুন হওয়ায় আতঙ্ক বেড়েছে

ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যার ২ বছর পর গত ৩ মাসে ধারাবাহিকভাবে ঢাকায় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ড. অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু এবং সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করে উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর লোকজন। এতে ব্লগারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

অভিজিৎ হত্যার দায়ে সন্দেহভাজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিউর রহমান ফারাবিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর এ ব্যাপারে আর কোন অগ্রগতির খবর পাওয়া যায়নি।

ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যার করে পালানোর সময় জিকরুল্লাহ ও আরিফুল নামের দুই মাদ্রাসা ছাত্রকে ধরে ফেলে স্থানীয় জনতা, অপর এক খুনি পালিয়ে যায়।
কিন্তু অনন্ত বিজয় দাশকে প্রকাশ্যে হত্যা করার পর সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করলেও প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

আনসারুল্লাহর হিটলিস্ট

বিভিন্ন সময় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) হিটলিস্ট প্রকাশ করে। তাতে রয়েছে বাংলাদেশের বেশ কিছু ব্লগার, লেখক, শিক্ষক ও সাংবাদিকের নাম। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ।

২০১৩ সালের ৩১ মার্চ  ইসলামবিদ্বেষী ৮৪ ব্লগারকে চিহ্নিত করে ছবিসহ তাদের নাম-ঠিকানা ও ব্লগের বিবরণ এবং আপত্তিকর মন্তব্যগুলোর প্রিন্ট কপি হেফাজতপন্থি আলেমদের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হয়। ওই তালিকায় থাকা পাঁচ ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, তাদের কাছে যে ৮৪ ব্লগারের তালিকা দেয়া হয় তারা সবাই বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করে আসছেন।

“যারা ব্লগে কটূক্তিমূলক লেখা পোস্ট করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। গোয়েন্দা পুলিশ অতীতেও এ ধরনের ব্লগারদের আইনের আওতায় এনেছে। তাদের নিরাপত্তা দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়।,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম।


ই-মেইলের উত্তরে ওমর ফারুক

বেনার নিউজের পক্ষ থেকে সোমবার লুক্সকে ই-মেইলে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়, প্রধানত শফিকুলের হুমকি সম্পর্কে এবং জার্মান পুলিশ তাকে কিভাবে নিরাপত্তা দিচ্ছে, চলাফেরায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। এ সব প্রশ্নের জবাব দিলে তার সমস্যা হতে পারে বলে উত্তর দিতে তিনি অস্বীকার করেন।

তবে তিনি বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বেশ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমি একজন স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার কর্মী। বাংলাদেশে মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে জনগণের ধারণা এবং বর্তমান অবস্থার ব্যাপারে সরকারের রাজনৈতিক অবস্থান এবং মনোভাব, দেশে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা বলে মনে করি”।

তিনি একের পর এক ব্লগার হত্যা এবং এ বিষয়ে সরকার এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর ভূমিকা, ব্লগারদের নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ বলে উল্লেখ করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।