হিটলিস্টে থাকা ব্লগারদের দুর্বিষহ জীবন, দেশছেড়ে বা লুকিয়ে বাঁচার চেষ্টা
2015.08.10
ব্লগারদের ৮৪ জনের ‘হিটলিস্ট’ ধরে একের পর এক খুনের ঘটনায় বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার বিকাশ রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি না করলেও মুক্তচিন্তার পক্ষে মত প্রকাশ করা ব্লগাররাও ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
এদিকে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বলেন, “ধর্মের নামে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড চলতে দেওয়া হবে না। ইসলামকে শান্তির ধর্ম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই ধর্মকে যারা কলুষিত করে চলেছে, তারা আর যাই হোক ধর্মে বিশ্বাসী নয়”। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্মের নামে রক্তপাত চলতে দেওয়া হবে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
“ব্লগার নীল হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রাখলেন সেখানে একটিবারও তার নাম উচ্চারণ করার সাহস দেখাননি। তাহলে আমরা সরকারের ওপর কীভাবে আস্থা রাখব?” বেনারকে জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
অন্যদিকে, পুলিশের আইজির কিছু বক্তব্যকে ইঙ্গিত করে তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রযন্ত্রের নীতি নির্ধারক ও পদস্থ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা ব্লগার হত্যা নিয়ে কথা বলে বিতর্কিত হতে চান না। এটা দুঃখজনক।”
আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ব্লগাররা
৮৪ জনের কথিত এই তালিকায় থাকা চারজন ব্লগারের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জানা যায়, তাঁরা আতঙ্কের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। দল বেঁধে চলাফেরা করছেন। অনেকেই এর মধ্যে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। কেউ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
তবে কজন বিদেশে গেছেন বা কজন যাওয়ার চেষ্টা করছেন এই সুনির্দিষ্ট হিসাব কারও কাছে নেই। আবার বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেও সফল হননি, এমনও কয়েকজন আছেন, যাঁরা নিরাপত্তার কারণে তাঁদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ রেখেছেন।
“নিলাদ্রী বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। অনেকের সঙ্গে কথাবার্তাও বলছিলেন,” বেনারকে জানান সর্বশেষ নিহত ওই ব্লগারের স্ত্রী আশামনি।
আবার বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করেও কেউ কেউ যেতে পারেননি।
“অনন্ত বিজয় দাশের কথা জানি, সে আবেদন করেও ভিসা পায়নি,” জানান বাংলাদেশে ব্লগিংয়ের শুরু থেকে যুক্ত অমি রহমান পিয়াল।
তিনি জানান, ২০১৩ সালে ওই হিটলিস্ট প্রকাশ হওয়ার পর থেকে ব্লগাররা মানবিক দুর্যোগের মুখে পড়েছেন। কেউ বিদেশে গেছেন, কেউ কেউ চেষ্টা করছেন। কেউবা আত্মগোপনে থাকেন।
“ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা থাকা একটি দেশে এমন পরিস্থিতি চলতে পারে না। কাগজে–কলমে এসব বিষয় উল্লেখ থাকলেও এর যে প্রয়োগ নেই তার প্রমাণ এমন হুমকি, এসব নৃশংস ঘটনা,” বেনারকে জানান সুশাসনের জন্য নাগরিক–সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।
ঘটনার পরদিন লন্ডনপ্রবাসী প্রবীণ লেখক আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, “সরকার জামায়াত এবং হেফাজতের রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমনে অনেকটা সফল হয়েছেন, কিন্তু এই ধর্মান্ধ ঘাতক গ্রুপগুলোর ব্যক্তিভিত্তিক সন্ত্রাস ও গুপ্ত হত্যা দমনে সফল হচ্ছে না।”(ইত্তেফাক, ৯ আগস্ট)
আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, “অনেকের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ, এমনকি প্রশাসনের ভেতরে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের সমর্থক না হলেও সহানুভূতিশীল একটি অংশ আছেন।”
অভিযোগ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে
ব্লগারদের অভিযোগ, তালিকা ধরে তাঁদের হত্যা করা হলেও তা ঠেকাতে বা আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর সঙ্গে জড়িতদের ধরতে পারছে না আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এরই মধ্যে ৯ আগস্ট পুলিশ সদর দপ্তর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো লেখালেখি না করতে মুক্তমনা লেখকদের পরামর্শ দেন। সেই সঙ্গে কারও লেখা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো হলে তা-ও পুলিশকে জানাতে বলেন তিনি।
গত ৭ আগস্ট নীলাদ্রী খুন হওয়ার পর ৯ আগস্ট পুলিশ প্রধানের এই বক্তব্য ভালোভাবে নেননি ব্লগারেরা।
“দেশে পুলিশের নিরাপত্তা পাব না, বিদেশেও যেতে ভিসা পাব না, তাহলে আমাদের যাওয়ার জায়গাটা কোথায়,” প্রশ্ন রাখেন অমি রহমান ।
তাঁর মতে, “আমরা কী এভাবে বসে বসে মরে যাবো, না ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই করব। অবশ্য সেই লড়াইয়ের জন্য সরকার ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সাহায্য প্রয়োজন, এটা আরেক বাস্তবতা।”
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ আনজুমানে আল বাইয়্যিনাত নামের একটি সংগঠন ‘নাস্তিকদের লিস্ট’ শিরোনামে সরকারের কাছে ৫৬ জনের একটি তালিকা দেয়। এরপর হেফাজতে ইসলাম ওই ৫৬জনসহ ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এরপর আনসারউল্লাহ বাংলা টিমও ওই তালিকা অনুযায়ী হুমকি দেওয়া শুরু করে।
এই ৮৪ জনের সবাই বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করতেন।
তাঁদের তালিকা ধরে ওই বছরের ১ এপ্রিল ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন, মশিউর রহমান বিপ্লব, সুব্রত অধিকারী শুভ ও রাসেল পারভেজকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জামিনে ছাড়া পেয়ে কিছুদিন নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলেন। পরে এদের মধ্যে তিনজন দেশ ছাড়েন।
“ব্লগারদের গ্রেপ্তার, তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের অজামিনযোগ্য ধারায় মামলার হুমকি এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হর্তাকর্তাদের বক্তব্যে আমরা বিস্মিত। এভাবেই বিচারহীণতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে,” জানান ইমরান এইচ সরকার।
নীলাদ্রির জিডি নেয়নি, মুন্সীর জিডি নিয়েছে
অনন্ত হত্যার প্রতিবাদে শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশ থেকে ফেরার পথে গত ১৩ মে দুই যুবক নীলাদ্রিকে অনুসরণ করে। বিষয়টি টের পেয়ে নীলাদ্রি আগেই বাস থেকে নেমে যান।
নীলাদ্রি গত ১৫ মে ফেসবুক পাতায় লেখেন, “... তারা জিডি নিল না। বলল, এটা আমাদের থানাধীন না, অমুক থানার অধীনে পড়েছে, ওখানে গিয়ে যোগাযোগ করুন, আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশ ছেড়ে চলে যান।”
আবার ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধনের জিডি নিয়েছে পুলিশ।
“আমাকে হুমকি দেয়, সেইটা তো নাওয়া-খাওয়ার মতো প্রাত্যহিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি পল্লবী থানায় একটি জিডি করেছি।” ফেসবুকের পাতায় লিখেছেন মুন্সী।
কেমন আছেন ব্লগাররা
ব্লগিংয়ে শুরু থেকে যুক্ত ও কথিত তালিকায় নাম আছে এমন ব্লগারদের বেশির ভাগই নিয়মিত লেখা ছেড়েছেন, পুরোনো লেখাগুলো মুছে ফেলেছেন অথবা সরিয়ে দিয়েছেন।
মুঠোফোন নম্বর, ঢাকার বাসা ঘন ঘন পরিবর্তন করেছেন কয়েকজন।
“নয়টা-পাঁচটা অফিস হলে সকালে অফিসে যেতে হবে, বিকেলে ফিরতে হবে। এই রুটিনে চললে আমি খুন হয়ে যেতে পারি। আমি ভয়ে ঘরে বসে থাকলে সেখানে এসেও তারা মেরে ফেলতে পারে,” নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা তুলে ধরে জানান অমি রহমান।
পিয়াল বলেন, “ঘরে ঢুকেই যদি হত্যার ক্ষমতা খুনিরা রাখে তাহলে আমি কোথায় নিরাপদ।”
“অনেক ব্লগার বন্ধু দেশ ছাড়ছেন। আমি এখনো সে লাইনে চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন যে অবস্থা দেখছি, জানি না কত দিন দেশে থাকা সম্ভব হবে,” ৮ আগস্ট বিবিসি বাংলাকে জানান ব্লগার একুশ তাপাদার।
তিনি বলেন, “দেশের বাইরে যাওয়া, দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কখনোই ছিল না। এখন এই দেশ আমার জন্য কতটা নিরাপদ, সেটা নিয়েই আমি উদ্বিগ্ন।”