ব্লগার নিলয় হত্যার অভিযোগে শ্রম প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা রিমান্ডে
2015.08.14

ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয় হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর পুলিশ সাদ আল নাহিন নামে এমন এক আসামিকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে যিনি সরকারের শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুর ভাতিজা।
নাহিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) থেকে পাস করেছেন।
২০১৩ সালে উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার পর নাহিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এক বছরের বেশি সময় জেল খাটার পর সম্প্রতি তিনি জামিনে ছাড়া পান।
নাহিন ছাড়াও আরেক যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে, যার নাম মাসুদ রানা। রানার বিরুদ্ধে আরেকজন ব্লগারকে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে, যাঁর নাম প্রকাশ করতে চায়নি পুলিশ।
“ওই দুজন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তারা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন হত্যা চেষ্টা মামলারও আসামি ছিলেন,” বেনারকে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার।
পুলিশের দাবি, গত বৃহস্পতিবার ঢাকার উত্তরা এলাকার সাত নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে নাহিন এবং মিরপুরের কালশী থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
শুক্রবার উপকমিশনার জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের কাছে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, নীলাদ্রি হত্যার ঘটনায় তাঁরা জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
তবে পরিবারের দাবি, নাহিনকে পাঁচ দিন আগে পুলিশ পরিচয়ে উত্তরার বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
“গত শনি বা রোববার গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে এসে একটি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে আমার ছেলেকে নিয়ে যায়। এরপর আমরা আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি,” টেলিফোনে বেনারকে জানান নাহিনের বাবা নজরুল হক।
“নাহিন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তারা কয়েকজন মিলে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যার চেষ্টা করার স্বীকারোক্তি দেন,” বেনারকে জানান ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ।
আসিফকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হলেও এর মাস খানেক পর মিরপুরে খুন হন ব্লগার রাজীব হায়দার।
আর চলতি বছরে নিলয় সহ চারজন ব্লগারকে একইভাবে হত্যা করা হলো। এর আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ীতে ওয়াশিকুর রহমান এবং ১২ মে সিলেট নগরের সুবিদ বাজারে অনন্ত বিজয় দাশকে খুন করা হয়।
শিক্ষকের ছেলে, প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা
নাহিনের বাবা নজরুল হক কিশোরগঞ্জের একটি স্কুলের শিক্ষক। তিনি কিশোরগঞ্জের তাড়াইলের দাহিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু তার বড় ভাই।
চুন্নু জাতীয় পার্টির থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। মাঠ প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় এইচ এম এরশাদের বিশেষ নজরে পড়েন তিনি, এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে যোগ দেন।
প্রায় দেড় বছর আগে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে হত্যার জন্য পরিচালিত হামলায় ভাতিজা নাহিনের নাম এলে শ্রম প্রতিমন্ত্রী চুন্নু বিব্রত হন। ওই মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই এবার নীলয় হত্যাকাণ্ডে ফের নাহিনের যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
“আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, ভাতিজা যদি কোনো অপরাধে জড়িয়ে থাকে, আইন অনুযায়ী তার বিচার হোক,” সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক ।
নাহিনের বলার কিছু নেই
নিলয় হত্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক শেখ মাহাবুবুর রহমান দুই আসামিকে শুক্রবার আদালতে হাজির করে দশ দিনের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক মোল্লা সাইফুল ইসলাম আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
“নিলয় হহত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নাহিন ও রানার সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার, আর কারা তাতে জড়িত ছিল- এসব বিষয়ে জানতে দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন,” আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা দীপক দে রিমান্ড আবেদনের শুনানিতে এ কথা বলেন।
আদালতে নাহিন ও মাসুদের পক্ষে শুনানিতে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। তাদের জামিনের জন্যও কোনো আবেদন ছিল না।
শুনানির একপর্যায়ে বিচারক জানতে চান, তাদের কিছু বলার আছে কি না। জবাবে নাহিন জানান, তার কিছু বলার নেই।
নিলয় হত্যা মামলা
গত ৭ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে ব্লগার নিলয়ের বাসায় ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী আশামণি অজ্ঞাতপরিচয় চারজনের বিরুদ্ধে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
নাহিন ও রানাও ওই চারজনের মধ্যে ছিলেন কি না জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মাহবুবুল আলম বলেন, “আমাদের কাছে কিছু তথ্য রয়েছে, আমরা এদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তা যাচাই-বাছাই করব।”
ঘটনার পর গত ৮ আগস্ট ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা একটি গামছা ও ৯ আগস্ট নীলাদ্রির রক্তমাখা শার্ট, রক্তের নমুনা, একটি দাঁতের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে।
বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই হত্যার বিচার দাবি করে আসছে।
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, “আমার প্রশ্ন—এই জঙ্গি সাদ আল নাহিনকে কী নিলয়কে হত্যার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল? মহিউদ্দীনের ওপর হামলার অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করার পর সে অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। তারপরও তাঁকে জামিন দেওয়া হলো কেন?,”
তিনি বলেন, প্রতিমন্ত্রীর ভাতিজা বলে যদি কোনও জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে এর দায় সরকার এড়াতে পারে না।