চলতি বছর বিএসএফ’র হাতে নিহত ৪৫ বাংলাদেশি
2015.12.24

দুদেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেগুলোতে বারবার সীমান্ত হত্যা শুণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করলেও ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর হাতে প্রায় প্রতিমাসেই প্রাণ দিচ্ছে কোন না কোন বাংলাদেশি। গত পাঁচ বছরের মধ্যে চলতি বছর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর গুলিতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
তবে তাদের এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেননি বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ’র (বিজিবি)মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। সীমান্তে হত্যাকান্ড বন্ধে রাতের বেলা সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের চলাচল সীমিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। (বিবিসিবাংলা)
বিএসএফ’র সর্বশেষ শিকার ঠাকুরগাঁওয়ের হেমন্ত
গত মঙ্গলবার (২২ ডিসেম্বর) ভোরে বিএসএফ’র সর্বশেষ শিকার হলেন ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার খোলড়া গ্রামের বাসিন্দা হেমন্ত চন্দ্র (৩২)।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে হরিপুর থানার ওসি আক্তারুজ্জামান জানান, ওইদিন ভোরে হেমন্ত গরু আনতে সীমান্তের ২৭১ নম্বর পিলারের পাশ দিয়ে ভারত প্রবেশের পর বিএসএফের রায়পুর ক্যাম্পের টহল দলের সদস্যরা গুলি করে, তাতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। পরে বিএসএফ হেমন্তের লাশ ভারতের রায়পুর থানায় হস্তান্তর করে।
তবে হেমন্ত গরু ব্যবসায়ী নন বলে দাবি করেন তার বাবা যতীন্দ্র চন্দ্র। আর কেন হেমন্ত ভারতে গিয়েছিলেন তা তিনি জানতেন না।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এমন হেমন্তের সংখ্যা বছরে বছরে বাড়ছে। এ বছরও বিএসএফ’র গুলিতে নিহত বাংলাদেশিদের সংখ্যা গত বছরকে ছাড়িয়ে গেছে।
‘চলতি বছর বিএসএফ’র হাতে নিহত ৪৫ বাংলাদেশি’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরে এপর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ৪৫জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৩১ জনকে গুলি করে ১৪জন শারীরিক নির্যাতনে মারা হয়েছে। আর গতবছর সীমান্তে ৩৩জন বাংলাদেশিকে হত্যা করে বিএসএফ।
আরেক মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’র তথ্যমতে, এ বছর নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে ৪১জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৬০জন। আর ২৭ জন বাংলাদেশীকে বিএসএফ অপহরণ করেছে।
অধিকারের হিসেবে, ২০১০ সালের পর এ বছর বিএসএফের গুলিতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা ২০১৩ সালে ছিল ২৯জন। ২০১২ সালে ৩৮জন আর ২০১১ সালে ৩১জন। এর আগে ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৪জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নুর খান বেনারকে বলেন, দুই সরকার প্রধান যৌথ বিবৃতির পরেও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এটার পিছনে বিএসএফ দাবি করত, ভারত থেকে চোরাচালান পথে গরু আনার কারণে এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কিন্তু গত এক বছরে গরু চোরা চালানের সংখ্যা কমে গেলেও মৃতুর সংখ্যা বেড়েছে। ফলে তাদের এই চুক্তি ধোপে টিকে না।
তবে সীমান্ত হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ব্রিটিশদের দেশভাগের ভুল ফর্মূলাকে দায়ী করে বলেন, “যেভাবে দুদেশের সীমানা বিভক্ত করা হয়, তাতে দেখা যায়, সীমান্ত এলাকার পরিবার বিভক্ত হয়েছে বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিভক্তি এসেছে। ফলে এপারের মানুষ ওপারের স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া বা ওপারের মানুষের এপারে আসা দেশভাগের পর থেকেই প্রচলিত ছিল। তারা হাটবাজার, খেলাধুল, স্বাস্থ্য সেবা এমনকি শিক্ষার ক্ষেত্রেও সীমান্ত পেরিয়ে একে অপরের দেশে যাওয়া আসা করত”।
আরেকটি কারণ হিসেবে যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের বিএসএফকে দায়ী করে নুর খান বলেন, সীমান্তে সেসকল বিএসএফ ডিউটি করে তাদের বেশিরভাগই বাংলা ভাষা বোঝে না। কখনও কখনও পাকিস্তান সীমান্তে কাজ করা বিএসএফ সদস্যদেরকে বাংলাদেশ সীমান্ত পাহারায় পাঠানো হয়। যুদ্ধ এলাকায় কাজ করে আসা এসব সদস্যদের ভিতরে ওই যুদ্ধাংদেহী মনোভাব থেকে যায়, বলে সীমান্ত হত্যার মত ঘটনা ঘটে থাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটলেও সীমান্ত হত্যার ক্ষেত্রে সেটি উল্টো দিকে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বিএসএফ কিংবা ভারত সরকারের সহানূভূতিশীল মনোভাবও নেই, মানবিক মূল্যবোধও জাগ্রত নেই।
প্রতিটি হত্যার ফৌজদারি বিচার দাবি
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নুর খানের মতে, বিএসএফ গুলি করে মানুষ মেরেও অব্যাহতি পাচ্ছে। তাদেরকে জবাবদিহিতায় আনতে প্রতিটি সীমান্ত হত্যাকান্ডের ঘটনার ফৌজদারি আদালতে বিচার হওয়া উচিত। এছাড়া যে দেশেই মারা যাক না কেন, প্রত্যেক লাশের ময়না তদন্ত দাবি করেন তিনি।
নূর খান বলেন, এই পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এক দেশ আরেক দেশকে দিতে বাধ্য থাকবে- এমন চুক্তিও করতে হবে। তাহলেই সীমান্ত হত্যা কমে আসবে।
সীমান্তে সতর্কতার সঙ্গে চলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সীমান্তে মারানাস্ত্র ব্যবহার হবে বলে দুই সরকার যেখানে একমত হয়েছে, সেখানে মারানাস্ত্র ব্যবহারও হচ্ছে। কখনো কখনো আবার পিটিয়ে মারার ঘটনা ঘটছে।
বিজিবি প্রধানের পরামর্শ
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য অস্বীকার করে বিজিবি`র প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ সীমান্তে হত্যার জন্য বাংলাদেশি গরু চোরাকারবারীদের তৎপরতাকে দায়ী করেছেন।
বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হত্যার বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে সীমান্তের ওপারে ভারতীয় ভূখন্ডে। চোরাকারবারীরা সব সময় চেষ্টা করে বিজিবি`কে ফাঁকি দিতে। চোরাকারবারীরা গরু আনতে কখনও কখনও সীমান্তের ৩/৪ কিলোমিটার ভেতরে চলে যায়। তিনি বলেন, “প্রতিনিয়ত গরু আসে দেশের মধ্যে। আমাদের কথা হচ্ছে গরু আনতে আপনারা যান কেন? ওরা যদি আপনাদের বর্ডারে এসে দিয়ে যায় তো দিয়ে যাবে। আপনারা কেন যাবেন?”
সীমান্তে হত্যার প্রশ্নে তাহলে শুধু বিএসএফকেই দোষারোপ করা চলে কি না, এই ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ ‘বাংলাদেশিদেরও দোষ রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন।
কিন্তু আইনভঙ্গ করে সীমান্ত অতিক্রম করলেই হত্যা করতে হবে কেন? এই প্রশ্নের জবাবে মেজর জেনারেল আাজিজ ভারতের সাথে আলোচনার সময় তিনি বরাবরই এই কথাটি তুলে আসছেন জানালেও ভারতীয় পক্ষ থেকে কোন জবাব ছিল কি না, সে সম্পর্কে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি বলে জানায় বিবিসি।
বিজিবি বিএসএফ সম্মেলন স্থগিত
ভারতের নয়া দিল্লীতে বিএসএফের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে বিএসএফ কর্মকর্তাসহ ১০ জন নিহতের ঘটনায় ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে। পাঁচ দিনব্যাপী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) এর মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ে সীমান্ত সম্মেলন বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) বিজিবি সদর দফতর পিলখানায় শুরু হওয়ার কথা ছিল।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিজিবি জানায়, সম্মেলনে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে বিএসএফ প্রতিনিধিদলের একটি অংশ (১০ জন) গত মঙ্গলবার সকালে ঢাকায় পৌঁছে। বিএসএফ মহাপরিচালক দেবেন্দ্র কুমার পাঠকসহ ১৩ জন বুধবার বিকালে ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু ওইদিন সকালে দিল্লী বিমানবন্দরে বিএসএফের একটি বিমান উড্ডয়নের সময় বিধ্বস্ত হয়ে বিএসএফের ২ জন ডিআইজি ও অপর ১ জন কর্মকর্তাসহ ১০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিএসএফ মহাপরিচালককে তার পূর্বনির্ধারিত ঢাকা সফর বাতিল করেন।
পরে বিজিবির জনসংযোগ দফতরের প্রধান মোহসীন রেজা বেনারকে বলেন, “বিমান দুর্ঘটনায় বিএসএফ সদস্য নিহতের সংবাদ পেয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বিএসএফ মহাপরিচালককে ফোন করে গভীর শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। শোকাবহ এ ঘটনার প্রেক্ষিতে উভয় মহাপরিচালক পরবর্তীতে সীমান্ত সম্মেলনের নতুন তারিখ নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। নতুন তারিখ নির্ধারিত হলে পরবর্তিতে জানানো হবে।”