চার শিশু হত্যার সন্দেহভাজন আসামি ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত
2016.02.25
রাজন, রাকিব, আবদুল্লাহ। এই নামের মিছিলে সর্বশেষ যোগ হয়েছে মনির, শুভ, তাজেল, ও ইসমাইল। এরা সবাই কোমলমতি শিশু। বাবা-মায়ের আদরের ধন। অন্যান্য শিশুদের মতই দুষ্টুমি আর চঞ্চলতায় পৃথিবীকে ভরিয়ে দেওয়ার কথা যাদের, পাশবিকতার বলি হয়ে তারা এখন পরপারে। প্রতিনিয়ত আবদুল্লাহ, রাজন কিংবা রাকিবদের মিছিল বাড়ছেই।
বাংলাদেশে ক্রমাগত এই শিশু নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে এবার আরো কঠোর অবস্থানে সরকার। শিশু নির্যাতনের অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গে মামলা গ্রহণ ও দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া শিশু হত্যাকারী সন্দেভাজনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
তবে শিশু নির্যাতন রোধে সরকারের এই কঠোর অবস্থান প্রসংশনীয় হলেও সন্দেহভাজনকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু হত্যা বা নির্যাতনকারীকে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া প্রয়োজন কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, বিনা বিচারেই কাউকে ‘ক্রসফায়ারে’ দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। এর মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত না হয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘণ হয়।
চার শিশু ‘হত্যাকারী’ বন্দুকযুদ্ধে নিহত
এদিকে বৃহস্পতিবার র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন সম্প্রতি সিলেটের হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশুকে হত্যা করে বালিচাপা দেওয়ার ঘটনার অন্যতম সন্দেহভাজন অটোরিকশা চালক বাচ্চু মিয়া।
শ্রীমঙ্গল র্যাব-৯’র কোম্পানি কমান্ডার কাজী মনিরুজ্জামান জানান, বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে চুনারুঘাটের দেবরগাছিতে গোলাগুলির ওই ঘটনা ঘটে।
ওই হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পুলিশ বলছে, স্থানীয় পঞ্চায়েতের বিরোধের জেরে বাহুবলের চার শিশুকে প্রথমে অপহরণ ও পরে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিলেন অটোরিকশা চালক বাচ্চু। ওই ঘটনায় তার অটোরিকশাও ব্যবহার করা হয়েছিল।
গোলাগুলির ঘটনার বিবরণ দিয়ে র্যাব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, ‘চার শিশু হত্যার আসামিদের ধরতে র্যাবের চালানো অভিযানে বুধবার রাতে সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে শাহেদ নামের এক ব্যক্তি আটক হন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই ব্যক্তি জানায়, আসামি বাচ্চু রাতেই দেওরগাছ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাবে। এটি জানার পর র্যাবের আরেকটি দল ওই এলাকায় অভিযানে যায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বাচ্চু ও তার লোকজন গুলি চালালে আমাদের দুইজন র্যাব সদস্য আহত হন। তারাও পাল্টা গুলি চালালে বাচ্চু মারা যায়। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল ও দুটি গুলিও উদ্ধার হয়েছে’।
শিশু নির্যাতনের অভিযোগ এলেই ব্যবস্থা
এদিকে শিশু নির্যাতন ও পরপর কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনায় তুমুল আলোচনার মধ্যে সরকারের আটটি মন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে শিশু নির্যাতন রোধে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
গত বুধবার মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেখানে ঘটুক না কেন মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে নির্যাতিত ব্যক্তি বা পরিবারকে অহেতুক হয়রানি না করে মামলা গ্রহণপূর্বক আনীত অভিযোগের বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর অন্যথা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।”
এছাড়া প্রতিমাসে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সভায় নারী ও শিশু নির্যাতন এবং হত্যা রোধে সচেতনতা বাড়াতে আলোচনা করতে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ সব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কার্যক্রম হাতে নিতে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, প্রতিটি এলাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, এনজিও কর্মী এবং কমিউনিটি ও গ্রাম পুলিশদেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়।।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, “শিশুশ্রম রোধে স্পেশাল ডাইভ দিতে হবে। বিষয়টি আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় আনতে একটি ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করতে হবে।”
পারিবারিক সৌহার্দ্য সৃষ্টির পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ বৃদ্ধি এবং পারিবারিক নির্যাতন রোধে জুমার নামাজের আগে আলোচনার জন্য ইমামদেরকেও নির্দেশনা সহ এ বিষয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেও বলা হয়েছে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে শিশু নির্যাতনের বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে। এছাড়া শিশু হত্যাসহ যে কোনো নৃশংস ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের বিষয়েও সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়
এদিকে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, শিশু নির্যাতন রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে আরো জবাবদিহিমূলক আচরণ করতে হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে নয়, আসামিকে সঠিক বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বেনারকে বলেন, ‘বিচার বহির্ভূত কোন হত্যকাণ্ডকেই আমরা সমর্থন করি না। আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতিও গ্রহণযোগ্য নয়। বিচারের লম্বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আসামিরা বেরিয়ে যায়। ফলে মানুষ বিচারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ে।’
চার শিশু হত্যা বিষয়ে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, ‘ওই শিশুরা হারিয়ে যাওয়ার পরে তাদের উদ্ধারে তৎপরতা না দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পিতা মাতাকে দোয়া দরুদ পড়তে বলেছে। এতে তাদের দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট। আবার সন্দেভাজনকে বিচারবহির্ভুতভাবে হত্যা করাও আরেক ধরনের দায়িত্বহীনতা। ’
এলিনা খান বলেন, ‘দেশে সুশাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। এসব ঘটনা রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এ সংক্রান্ত মামলাগুলোকে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারের নানা নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হয় না। যারা মানেনা, তারাও সরকারের অঙ্গ। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই।’
চার শিশু নিহত হয় যেভাবে
বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে গিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হয় বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের আবদাল মিয়া তালুকদারের ছেলে মনির মিয়া (৭), ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), আব্দুল আজিজের ছেলে তাজেল মিয়া (১০) এবং আব্দুল কাদিরের ছেলে ইসমাইল হোসেন (১০)। পাঁচদিন পর একসঙ্গে বালিচাপা দেওয়া অবস্থায় লাশ পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের সন্দেহ, গ্রামের দুই পঞ্চায়েত পরিবারের দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরেই চার নিষ্পাপ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।