আরো দুই শিশু হত্যা, সন্দেহ থেকে বাদ যায়নি বাবা-মাও
2016.03.02
বাবার কাছে চাইনিজের আবদার। তা খেয়ে নিদ্রা যাওয়া। কিন্তু সেই নিদ্রা চিরনিদ্রা হয়ে আসলো দুটি শিশুর জীবনে। বাবার কাছে করা সে আবদার জীবনের শেষ আবদার রইল। রেস্টুরেন্ট থেকে আনা খাবারের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলেও ময়নাতদন্তে ‘হত্যা’র প্রমাণ মেলায় ঘটনাটি এখন ভিন্ন মোড় নিয়েছে। রহস্য উদঘাটনে শিশু দুটির বাবা-মাসহ স্বজনদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শিশু হত্যার মিছিলে আরও দুটি নাম যোগ করলো।
গত সোমবার রাতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রামপুরায় নিজ বাসায় মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী নুসরাত জাহান অরণী (১৪) ও তার ছোটভাই হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারির ছাত্র আলভী আমানের (৬)। ক্রমেই যার রহস্য ঘণিভূত হচ্ছে।
ঘটনার দিন খাবারে বিষক্রিয়ার অভিযোগ পেয়ে সংশ্লিষ্ট হোটেলের তিন কর্মচারিকে আটক করে আদালতে পাঠানো হলেও বুধবার নিহত দুই শিশুর বাবা, মা ও খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্ত
এই দুই ভাই-বোনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাটিকে হত্যাকাণ্ড ধরে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পারিবারিক কলহের মত খুটিনাটি বিষয়সহ নানা দিক তদন্তে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানান তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীও দেন সে আভাস। তিনি বলেন, “দুই শিশু কেন হত্যা করা হয়েছে, তা তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের আগে কিছু বলতে পারছি না। তবে আমরা সন্দেহ করছি অনেক কিছু।”
এছাড়া ওই ঘটনায় বাসাটি থেকে আলামত হিসেবে বালিশ, বিছানার চাদর, বালিশের কভার, টিস্যু ও কম্বল জব্দ করা হয়। এছাড়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টের খাবার বোতলের সংরক্ষিত পানিও সংগ্রহ করা হয়। পুলিশের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে জব্দ করা সেসব আলামত ডিএনএ প্রোফাইলিং ও রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পুলিশকে অনুমতি দিয়েছে আদালত। ইতিমধ্যে তা পরীক্ষাগারে পাঠানোও হয়েছে।
এ বিষয়ে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, “ওই বাসা থেকে সংগ্রহ করা খাবারের কিছু অংশ, বালিশ আলামত হিসেবে জব্দ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।”
লাশ দাফনের পরেই বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ
মৃত্যুর পর দুই ভাইবোনের লাশ গত মঙ্গলবার ময়নাতদন্তের করা হলে সেখানকার চিকিৎসকরা শিশু দুটির শরীরে আঘাতের দাগ রয়েছে বলে জানান। এটা ‘হত্যাজনিত’ মৃত্যু বলেও অভিমত দেন তারা। এরপর বাসাটির দুই দারোয়ান, গৃহশিক্ষিকা এবং এক আত্মীয়কেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেয় র্যাব। যারা এখনও তাদের হেফাজতে আছে।
এ বিষয়ে শিশু দুটির বাবা-মাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বুধবার জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে তাদেরকে দাফনের পর সেখান থেকে দুই শিশুর বাবা আমানুল্লাহ, মা মাহফুজা মালেক জেসমিন ও খালা আফরোজা মিলাকে নিয়ে ঢাকায় ফেরে র্যাবের কর্মকর্তারা। তবে তাদেরকে গ্রেপ্তার বা আটকের কথা তারা স্বীকার করেননি। র্যাব-৩ এর কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুশতাক আহমেদ বেনারকে জানান, “বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে হত্যার ঘটনাটির তদন্ত চলছে। তারই অংশ হিসেবে আমরা শিশু দুটির বাবা-মা এবং খালাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে এসেছে।”
তবে পুলিশের দাবি নিহত অরণী ও আলভীর মৃত্যুর পর তাদের মা-বাবার কিছু আচরণও 'সন্দেহজনক' মনে হয়েছে। তারা বলছে, প্রথম থেকেই কিছু 'রহস্যজনক' আচরণ করছেন তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। তার দেওয়া কিছু তথ্যের সঙ্গে বাসাটির গৃহশিক্ষিকার দেওয়া তথ্য মিলছে না।
শিশু দুটির লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রেখে তাদের বাবা-মা খানিকটা তড়িঘড়ি করেই মঙ্গলবার ভোরে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে চলে যান। এ বিষয়টি নিয়েও নানা সন্দেহ তৈরি হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে সেসব পরিষ্কার হবে বলে আশা করছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
প্রতিক্রিয়া
দেশে একের পর এক শিশু হত্যার খবর সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া যেমন তৈরি করছে তেমনি এক ধরনের ভীতির সঞ্চারও করছে। শিশু হত্যাকারীদের দ্রুত আটক করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি এখন আরো সুনির্দিষ্ট। সঙ্গে সাবধান হওয়ার সতর্কতাও।
জেসমিন মলি নামে একজন সাংবাদিক তার ফেসবুকে লিখেছেন “বাংলাদেশের মানুষ ভয়াবহ কোন ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাধির কারন এবং প্রতিকার জরুরী, না হলে ভয়াবহ দূর্যোগের দেরি নেই। প্রতিদিনই এক বা একাধিক শিশু হত্যার খবর আসছে। যাদের বাসায় শিশু রয়েছে তারা অত্যাধিক সতর্ক থাকবেন, পরিচিত অপরিচিত কারো কাছেই বাচ্চাকে একা ছাড়বেন না।”
সমাজকে আরো আগেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার তাগিদ দিয়ে অনাদৃত অর্ক নামে আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন “আওয়াজটা ত্বকী হত্যার পরপরই তোলা দরকার ছিল। কিন্তু তখন আপনি চুপ ছিলেন! রাজন-রাকিব হত্যার ভিডিও দেখে আপনার চেতনার ঘুম ভেঙেছে! এরপরও নিয়মিত বিরতিতে ফুলের মতো মুখগুলো নিষ্ঠুরতার বলি হয়েছে! তখন কেন চুপ ছিলেন? ভিডিও ছিলনা বলে? এভাবে হয়না। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের হিসাব মতে, ২০১৫ সালে ৫৭৫জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে! ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে এই তালিকায় যোগ হয়েছে ২৯ জন! অপহৃত হয়েছে ১৭জন। ভাবছেন হয়তো এ তালিকায় আপনার কেউই নেই! ভাই, নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?
শিশু হত্যার জোর প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি আরো লিখেছেন “আপনি মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। আপনার প্রবৃদ্ধি তরতর করে বাড়ছে। কিন্তু আপনি কতটুকু মানবিক সে প্রশ্ন কখনো করেছেন? শিশু মানেই প্রতিটি পরিবারে আলোকবর্তিকা। সমাজ কতটা অন্ধকারে পতিত এই আলোকবর্তিকাগুলোর নির্মম পরিণতিই তার বড় উদাহরণ! ফলে প্রতিবাদের ক্ষেত্রে বাছবিচার করলে চলবে না। বারাক ওবামা যেমন তেমনি রফিউর রাব্বি কিংবা কুমিল্লার রিয়াদের বাবা। পিতৃ হৃদয়ের ধনী গরিব নাই ! শিশু হত্যার বিরুদ্ধে জোরসে বলতে হবে। হত্যাকারীদের ঠাঁই দেওয়া চলবে না।”
দ্রুততম সময়ে বিচারের প্রতিশ্রুতি
এদিকে দ্রুততম সময়ে শিশুহত্যার বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তিনি বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, সকল শিশু হত্যাকারীদেরকেই দ্রুততার সঙ্গে বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। নানা ধরনের ‘ফায়দা হাসিলের’ জন্য শিশু হত্যার মত পৈচাশিক কাণ্ড ঘটানো হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, দেশে বেশ কয়েকটি শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো অত্যন্ত হৃদয় বিদারক, পৈশাচিক। এগুলো যারা করেছে, তারা অমানুষ, পশুর চেয়ে অধম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, হত্যাকারীরা সেই শিশুর ‘কাছের আপনজন। অনেক বাবা-মাও শিশু হত্যার সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় জড়িত, পাড়া প্রতিবেশী জড়িত। সম্পত্তির লোভসহ নানান ধরনের ফায়দার জন্য এসব (হত্যা)হচ্ছে। হত্যাকারীদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। দ্রুততার সঙ্গে এসব হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র যাচ্ছে। আশা করছি বিচারও দ্রুততম সময়ে হবে।
শিশু হত্যা বাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ
সাম্প্রতিক সময়ে শিশু হত্যা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত সোমবার সংসদের নবম অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় তিনি বলেন, “শিশু হত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কেন এই জিঘাংসা? পরিবারের একটি ছোট ঘটনার জন্য একটি শিশুকে কেন হত্যা করা হবে?
শিশু হত্যা ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে তিনি বলেন, “যারা শিশু হত্যার সাথে জড়িত, আমি আশা করি আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে।”
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তৃতার রাতেই মারা যায় অরনী ও আলভী।