শিশু সুরক্ষায় কমিশন গঠনের প্রস্তাব

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.09.09
BD-child শিশু অধিকার সুরক্ষা নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আলোচনা সভা। ৬ সেপ্টেম্বর,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশে থেমে নেই শিশু নির্যাতনের ঘটনা। শিশু অধিকার সুরক্ষায় নানা ইতিবাচক নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে শিশু নির্যাতন, হত্যা বা শিশু শ্রমের মতো ভয়াবহ ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের। তাই শিশুদের গড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি এবং অধিকার রক্ষায় ‘শিশু অধিকার কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব করেছেন তারা। তবে এ ধরনের কোন কমিশন গঠনের চিন্তা এখনই নেই বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

গত রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইন সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আয়োজিত ‘শিশু অধিকার সুরক্ষায় প্রয়োজন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো’ শীর্ষক এক সভায় শিশু অধিকার কমিশনের দাবি উঠে আসে।


সাড়ে তিন বছরে ৯৬৮ শিশু নির্যাতন

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে তিন বছরে ৯৬৮ শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ২০৯ জন, ২০১৩ সালে ২১৮ জন, এবং ২০১৪ সালে ৩৫০ জন। শুধুমাত্র জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৯১ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে এবং ৯৬ জন শিশু ধর্ষিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় একজন  শিশু হত্যা এবং ধর্ষণের  শিকার হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সংগৃহীত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪০৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আর ১৬৪ জন শিশু নির্যাতনের কারণে মৃত্যুবরণ করেছে।

কেন প্রয়োজন

সভায় সংশ্লিষ্টরা বলেন,  শিশু নির্যারতনের এই পরিসংখ্যান আঁতকে উঠার মতই। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশই শিশু হলেও এদেশে তারা মোটেই সুরক্ষিত নয়। শিশুদের সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠার পরিবেশ তৈরি, অধিকার সংক্রান্ত বিষয় দেখা এবং সুরক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে বিশেষ একটি মানবাধিকার কাঠামো থাকা অত্যন্ত জরুরি। যা বিদ্যমান নীতিমালা আইন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার ফাঁকফোকরগুলো কাটিয়ে সেগুলোকে আরো শক্তিশালী করে শিশুদের সুরক্ষায় কাজ করবে। এই প্রতিষ্ঠান শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতিসমূহ জাতীয় পর্যায়ে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তা তদারকি এবং প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেবে। এভাবে জবাবদিহিতার অভাব বা দায়হীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে প্রতিটি শিশুর জন্য একটি আশ্রয়স্থল, একটি কার্যকরি সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে বলে বক্তারা আশা প্রকাশ করেন।


‘আদালতের রায় উপেক্ষিত’

আসকের আয়োজিত সভায় বিচারপতি ইমান আলী বলেন, “ ২০০৯ সালে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে শিশু অধিকার কমিশন গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে রায় আজও উপেক্ষিত। সরকার এ পর্যন্ত তা বাস্তবাযন করেনি। সংবিধান এবং অন্যান্য আইনে শিশু অধিকার সংরক্ষণে রাখার প্রতিশ্রুতি কিংবা আইন বাস্তবে সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা দেখার জন্য একটা বিশেষ কাঠামো দরকার”।

তাঁর মতে, এক্ষেত্রে শিশু অধিকার কমিশন গঠন করে বিচারবিভাগের একজন বিচারককে কমিশনার হিসেবে নিয়োগ করা যেতে পারে। পাশাপাশি সেখানে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। এই কমিশন খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিশুকে নানা ধরনের হয়রানি থেকে সুরক্ষা দেবে।


‘জবাবদিহিতায় পড়বে সরকার’

মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ড. হামিদা হোসেন বলেন, “সরকার নিজের ইচ্ছেমত অঙ্গিকার করে, প্রতিশ্রুতি দেয়। আইন বা নীতিও গ্রহণ করে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন আর হয় না। কেননা সরকার মনে করে এসব অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার কেউ নেই। তাই জবাবদিহিতা করতে হবে না। শিশুদের জন্য শক্তিশালী কমিশন গঠন করে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব। তবে একে কার্যকরী করতে নাগরিক কর্মপ্রচেষ্টা থেমে গেলে চলবে না”।


‘ন্যায়পালের নিয়োগে সীমাবদ্ধতা আছে’

শিশু ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য ২০০৬ সালে একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রিপরিষদে পর্যালোচনা করা হলেও পরবর্তীতে তা অনুমোদিত হয়নি। ২০১১ সালে গৃহিত জাতীয় শিশু নীতিতে শিশু ন্যায়পালের বিষয়টির উপর জোর দেওয়া হয়।

সংবিধানের ৭৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ থাকা ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারেও উল্লেখ ছিল। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি বিষয়টি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তাই শিশু অধিকার সুরক্ষায় স্বাধীন কমিশন গঠনই জরুরি।

বিচারপতি ইমান আলী বলেন, “ ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। সরকার ২০০৬ সালে এ ধরনের উদ্যোগ নিলেও পরে তা ভেস্তে গেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের উপর নজরদারি করার ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্যতা পায় না কখনও। তাছাড়া সাংবিধানিকভাবে ন্যায়পালের কাজের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে”।

বেসরকারী সংস্থা এডুকো’র কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. নিজাউদ্দীন বলেন, ন্যায়পালের পরিধি সীমিত। এক্ষেত্রে কমিশনই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, “শিশুর অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ আর রাষ্ট্রের কেননা শিশু নিজে তা করতে পারবে না। ন্যায়পালের ক্ষমতা সীমিত বিধায় শিশুর সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি কমিশন প্রয়োজন”।

সভার সভাপতি আসক’র নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, “শিশুদের বর্তমানই যেখানে বিপন্ন সেখানে তার ভবিষ্যৎ কী? সবটুকু মানবিকতা দিয়ে আজ শিশু অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। এ জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অবশ্যই প্রয়োজন আছে”।

কমিশন কিভাবে গঠন করা যায়, সেটার কাঠামো,  ক্ষমতা এবং কার্যাবলী কেমন হবে সেটা নিয়ে শীঘ্রই একটি খসড়া তৈরি করে সরকারকে দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।


সরকারের অবস্থান

এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চাইলে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিকাশ কিশোর দাস বেনারকে বলেন, “এ ধরনের কোনো কমিশন গঠন করার কোন চিন্তা এখনই সরকারের নেই।”

তবে বর্তমানে শিশু অধিদপ্তর গঠনের কাজ চলছে বলে বেনারকে জানান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব রহিমা আক্তার।

তিনি বলেন, “শিশু কমিশন গঠনের বিষয়টি চিন্তায় না থাকলেও অধিদপ্তর গঠনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। এর রূপরেখা নিরুপণে ইতিমধ্যে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকও করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারের ছয় থেকে সাতটি মন্ত্রণালয় শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করে। যেমন শিশু নির্যাতনের বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো দেখাশুনা করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত মন্ত্রণালয় হলেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে শুধু মাত্র শিশু একাডেমি। অধিদপ্তর গঠন হলে এসব কাজের সমন্বয় করা হবে”।

শিশু অধিকার কমিশনের বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তাহমিনা বেগম বলেন, “শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষার দিকটি বাংলাদেশ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করছে। পার্শ্ববর্তি দেশগুলোর দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে কমিশনের ধারণা সামনে চলে আসে। বর্তমানে সরকারের অবস্থান হচ্ছে নাগরিকরা যেটা চায় সেটা প্রতিষ্ঠা করা। এখন চিন্তায় না থাকলেও নাগরিকরা কমিশন চাইলে সরকার সেটা এগিয়ে নেবে”।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।