খসড়া আইনে ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের বিধান‏

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.12.01
BD-child বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ছে।
অনলাইন

১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার ‘বিশেষ বিধান’ বহাল রাখা হল বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়ায়। এই মতামত দিয়ে খসড়াটি মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ-বিষয়ক বিভাগ।

তবে এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে এবং বৃহত্তর স্বার্থে চূড়ান্ত খসড়ায় ‘বিশেষ বিধান’ টিকবেনা বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।


যা আছে বিশেষ বিধানে

খসড়া আইনের ১৬ নম্বর ধারায় নানা সময়ে সমালোচিত বিশেষ বিধানটি উল্লেখ রয়েছে। তাতে বলা আছে ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন বিশেষ কারণ থাকিলে অথবা বিশেষ কারণের উদ্ভব হইলে, পিতা, মাতা বা অভিভাবকের সম্মতি অথবা আদালতের অনুমতিক্রমে ১৬ (ষোল) বৎসর পূর্ণ করিয়াছেন এমন কোন নারীর সহিত ২১ (একুশ) বা তদূর্ধ্ব বৎসরের অধিক বয়স্ক কোন পুরুষের বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা বাল্যবিবাহ বলিয়া গণ্য হইবে না।’

তবে বিশেষ বিধান ছাড়া খসড়ায় ২১ বছর পূর্ণ করেননি এমন ছেলে এবং ১৮ বছর পূর্ণ করেননি এমন মেয়েকে ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ বোঝানো হয়েছে।


আলোচনার সুযোগ রয়েছে

আইন মন্ত্রণালয় ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার বিশেষ বিধানের পক্ষে মতামত দিলেও এটাই চূড়ান্ত নয় বলে মত দিয়েছেন মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংলিষ্টরা। তারা মনে করেন এ বিষয়ে এখনো আলোচনার সুযোগ রয়েছে। খসড়াটির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় তাদের মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম বেনারকে বলেন, ‘আইনের খসড়াটি নিয়ে এখনো নানা আলোচনার সুযোগ রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের পাঠানো খসড়াটির সবটুকু আমরা গ্রহণ করতে পারি, আবার বিভন্ন বিষয়ে দ্বিমতও করতে পারি। খসড়াটি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হবে। এরপরেই আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো।’

এর আগে মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৪ নামে আইনের খসড়াটির বিষয়ে মতামত জানতে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওইস সময় তাতে উল্লেখ ছিল, ‘যুক্তিসংগত কারণে মা-বাবা বা আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছর বয়সে কোনো নারী বিয়ে করলে সেই ক্ষেত্রে তিনি “অপরিণত বয়স্ক” বলে গণ্য হবেন না।’

তবে মতামতের জন্য পাঠানোর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর খসড়া আইনটির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি অনুশাসন দেন। যাতে বলা হয়, “মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮, তবে পিতামাতা বা আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছর সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এতে করে সামাজিক সমস্যা কম হবে।’

গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সাজা ও জরিমানার পরিমাণ বাড়িয়ে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৪’-এর খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। একই বৈঠকে ১৯২৯ সালের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ছেলেদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ২১ থেকে ১৮ এবং মেয়েদের ১৮ থেকে ১৬ করা যায় কি না, তা পর্যালোচনা করার জন্য আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

এরপরেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। নারী ও শিশু অধিকার কর্মীরা এবং শিশু ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা  সরকারের এই ভাবনার বিপক্ষে মতামত দিতে থাকে। নারীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং অধিকারের কথা মাধায় রেখে বিয়ের বয়স কোনো শর্ত বা যুক্তিতেই না কমানোর দাবি জানিয়ে আসছে তারা।

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়ায় বিশেষ বিধান রেখে ১৬ বছর বয়সী নারীর বিয়ের বিধান বহাল রাখায় তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন নারী সংগঠন ও মানবাধিকার সংগঠন।

নারীপক্ষ, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, ব্লাস্ট, আমরাই পারি, নাগরিক উদ্যোগ, কেয়ার বাংলাদেশ, প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ও ঢাকা আহ্সানিয়া মিশনের এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, "সরকারের এহেন অদূরদর্শী ও পশ্চাৎপদ উদ্যোগে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, উদ্বিগ্ন। আমরা এই উদ্যোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং এখনই এই উদ্যোগ বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এই বিধান নারী অধিকার ও উন্নয়নের সঙ্গে সাংঘর্র্ষিক, যা নারীর শারিরীক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে শুধু বাধাগ্রস্থই করবে না বরং তার শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকারকে খর্ব করবে, যা বৃহত্তর অর্থে নারী উন্নয়ন ও সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ।”

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বেনারকে বলেন, “নানা মহলের আপত্তি স্বত্ত্বেও ১৬ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত দেওয়ার বিষয়টি হতাশার। একদিকে যেখানে নারীর ক্ষমতায়নের আন্দোলন চলছে, সেখানে নারীদের পিছিয়ে দেওয়ার মত এই শর্তযুক্ত আইনের খসড়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ কোনো কিছু বর্তমান নারীবান্ধব সরকার গ্রহণ করবে না।”


খসড়া আইনে আরো যা আছে

কেউ বাল্যবিবাহ করলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলে খসড়া আইনে বলা আছে। এতে অভিভাবকদের শাস্তির বিধানও আছে। তবে কোনো নারী আইনের আওতায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। এছাড়া রয়েছে বাল্যবিবাহ নিবন্ধকের জন্য দণ্ডের বিধান। তবে অপরাধ ঘটার দুই বছরের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হবে।

খসড়ায় আইন বলছে, বিয়ের সময় বয়স প্রমাণে জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট বা সমমানের পরীক্ষার সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট আইনগত দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।