সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে দুরকম সিদ্ধান্ত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.04.23
BD-citypoll সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নেমে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার গাড়ির উপর ৩য় দফা হামলায় গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ২২ এপ্রিল,২০১৫
বেনার নিউজ

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে, আবার হবে না—৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে নির্বাচন কমিশনের এমন পরষ্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি) কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধী দল বিএনপি।

অন্যদিকে সরকার বলছে, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, হলে কখন ও কীভাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের।
“সেনা মোতায়েন করাটা ইসির সিদ্ধান্ত। কিভাবে তারা এটা কার্যকর করবে সেই এখতিয়ারও ইসির। তাই ইসি যেভাবে চাইবে সেভাবেই সেনা মোতায়েন হবে,” বেনারকে জানান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।

তাঁর মতে, ইসি যদি বলে সেনাবাহিনী বাইরে মোতায়েন করতে হবে, সেটিই করা হবে। আবার ইসি মনে করতে পারে সেনাবাহিনী ব্যারাকে থাকবে, প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশন ডাকলে বাইরে আসবে।

গত বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে থমথমে অবস্থা ছিল দেশজুড়ে, তার বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। তখন ছিল শুধুই আতঙ্ক, এখন আতঙ্কের পাশাপাশি রয়েছে উৎসাহ–উদ্দীপনা।  

“নগরবাসী চায় একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। আমরা দীর্ঘ ১৩ বছর পর নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চাই। সেনা মোতায়েন করলে সেই নিশ্চয়তা হয়ত বাড়ত,” বেনারকে জানান ঢাকার মগবাজার এলাকার কাউন্সিলর প্রার্থী মুক্তার সরদার।

গতকাল বৃহস্পতিবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার নিন্দা জানিয়েছে। এসময় বলা হয়, নির্বাচনী প্রচারে নেমে পর পর তিন দিন কারওয়ান বাজার , নয়াপল্টন ও বাংলামটরে হামলার মুখে পড়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এসব ঘটনা সেনা মোতায়েনের দাবি যৌক্তিক করে তুলেছে।

“বিএনপি দাবি করেছিল প্রত্যেক কেন্দ্রে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়ন করতে হবে। সেনাবাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা আছে, কিন্তু সরকারের নেই। এজন্য সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত দিয়ে নির্বাচন কমিশন আবার পিছু হটেছে,” সংবাদ সম্মেলনে জানান বিএনপির আন্তর্জাতিক-বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান।

আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, “নির্বাচন কমিশন একচোখা নীতি নিয়ে চলছে। তারা চোখে কিছু দেখছে না। যেখানে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেখানে না নিয়ে অন্য জায়গায় ব্যবস্থা নিচ্ছে।”

নির্বাচন কমিশনের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মাঠে থাকছে না। তারা সেনানিবাসের ভেতরেই থাকবেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা তলব করলে তাঁরা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে আসবেন। ২২ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে পাঠানো চিঠিতে একথা বলা হয়।

অবশ্য এর আগের দিন ২১ এপ্রিল কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ২৬ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত সেনাবাহিনী তিন সিটিতে স্ট্রাইকিং ও অতিরিক্ত বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

এ উপলক্ষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “ তিন সিটিতেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো। তবুও ভোটারদের মনে স্বস্তি দিতে এবং ভোটাররা যাতে নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে আসতে ও যেতে পারেন, সে জন্য ২৮ এপ্রিল ভোটের দিন, তার আগের দুই ও পরের দিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী নির্বাচনের কাজে সহযোগিতা করবে।”

কমিশনের সিদ্ধান্তের পর পরই ২১ এপ্রিল বিকেলে কমিশন সচিবালয় থেকে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়। উপসচিব শামসুল আলমের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছিল, প্রতিটি সিটি করপোরেশনে এক ব্যাটালিয়ন সেনা সদস্য মোতায়েন করতে হবে। সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ও অতিরিক্ত (রিজার্ভ) বাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা ডাকলেই তাঁরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন।

২২ এপ্রিল ওই সিদ্ধান্ত পাল্টে বলা হয়, সেনাবাহিনী ব্যারাকে থাকবে, তাঁদের ডাকলে আসবে।

“কমিশনের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আর না নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যেকোনো সময়ে গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনী তলব করতে পারেন,” জানান সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন ।

সাবেক ওই সেনা কর্মকর্তার মতে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯ ও ১৩০ ধারা অনুযায়ী কোথাও কোনো গোলযোগ দেখা দিলে তা ছত্রভঙ্গ করার জন্য দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট সেনাবাহিনী তলব করতে পারবেন। তখন সেনা সদস্যরা গোলযোগকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আটক করতে পারবেন।

বিএনপি আগে থেকেই এই নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়ে আসছিল। সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ২১ এপ্রিল বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ কমিশনকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন।

“সিটি নির্বাচনে টালবাহানা করলে সরকার নিজের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারবে,” জানান আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, যেখানে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা-কর্মীদের রাস্তায় ফেলে মারা হয়, সেখানে সরকারের উচিত তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

“সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের যৌক্তিকতা নেই,” মনে করেন আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকন।  
তাঁর মতে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতি দেশবাসীর বিশেষ নজর ও মনযোগ থাকবে। থাকবে দেশী–বিদেশী পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের সতর্ক পাহারা। এ ছাড়া দুই দলের কাউন্সিলর প্রার্থী আছে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে।

সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা দেওয়ার দাবিটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক উল্লেখ করে তথ্যমন্ত্রী বলেন, “পুলিশ বা সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা থাকতে পারে না।”

১৯৯০ সালে তিনজোটের রূপরেখা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতা বাতিলের কথা উল্লেখ করে হাসানুল হক ইনু বলেন, “এতদিন পর এমন দাবি তোলা অগণতান্ত্রিক, উদ্দেশ্যমূলক এবং অবাস্তব। প্রকৃতপক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়া কারো হাতে বিচারিক ক্ষমতা থাকতে পারে না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।