অর্থমন্ত্রীর স্বীকারঃ দুর্নীতিতে ক্ষতি ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার, জিডিপির ৩ শতাংশ
2015.07.10
বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আরও ১ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। এই তথ্য জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বাজার মূল্যে দেশের জিডিপির আকার বর্তমানে ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা বা ১৯১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অর্থমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির ৩ শতাংশ ধরলে দুর্নীতির কারণে বছরে ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা বা ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
দেশে দুর্নীতি হচ্ছে, টিআইবির দাবি স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী
অবশ্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, বিচার ইত্যাদি—রাষ্ট্রের এমন সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অর্থের দুর্নীতি হয়, তার পরিমাণ জিডিপির আড়াই শতাংশের মতো।
ওই গবেষণা বলছে, রাষ্ট্রের বড় বড় ক্রয় খাতে যোগসাজশের মাধ্যমে যে দুর্নীতি হয়, এর পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশের মতো। সব মিলিয়ে দুর্নীতির পরিমাণ কমপক্ষে জিডিপির ৫ শতাংশের বেশি বলে টিআইবি হিসাব দিয়েছে।
“এত দিন ধরে দুর্নীতি বিষয়ে আমরা যা বলে আসছি, তা স্বীকার করলেন অর্থমন্ত্রী, এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ,” বেনারকে জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
তাঁর মতে, যারা এ ধরনের দুর্নীতির জন্য দায়ী, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বিচারব্যবস্থাকে কাজ করার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পরিবেশ দিতে হবে।
দুর্নীতি কমাতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে
৯ জুলাই ঋণ দাতাগোষ্ঠীর স্থানীয় পরামর্শক গ্রুপের (এলসিজি) সঙ্গে এক বৈঠকে আর্থিক ক্ষতির এই তথ্য তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে সরকার তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া নিয়ে ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে দাতাদের সঙ্গে এ বৈঠকে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান ও উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন সংস্থা প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে উপস্থাপন করা প্রবন্ধে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৩১ লাখ ৯০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে মাত্র ৩ লাখ ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা দেবে উন্নয়ন সহযোগীরা।
সপ্তম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২০ সালের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নিয়ে যাওযার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
এ বছর টানা সপ্তমবারের মতো বাজেট দেওয়া মুহিত এর আগেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁর ধারণা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবহার বাড়িয়ে এ ধরনের দুর্নীতি কমানো যাবে। এ জন্য সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে উন্নয়নের অন্যতম বাধা দুর্নীতিঃ যুক্তরাজ্য
অর্থমন্ত্রী এই বক্তব্য দেওয়ার একদিন আগে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দুর্নীতিকে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের উন্নয়নে অন্যতম বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
‘বৈদেশিক বাণিজ্য ঝুঁকি: বাংলাদেশ’ (ওভারসিজ বিজনেস রিস্ক: বাংলাদেশ) শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও দাতা সংস্থাগুলোর অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঘুষ ও দুর্নীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনেকাংশে জেঁকে বসেছে। ঘুষ ও দুর্নীতি রোধের সরকারি প্রক্রিয়াতেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। প্রক্রিয়াগুলো আমলাতান্ত্রিক বাড়াবাড়ির দোষে দুষ্ট।
বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঝুঁকি সম্পর্কে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে সে দেশের সরকার। তাতে রাজনীতি ও অর্থনীতি, মানবাধিকার, ঘুষ ও দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, প্রতিরক্ষামূলক নিরাপত্তা উপদেশ, মেধাস্বত্ব এবং সংঘবদ্ধ অপরাধ—এই সাতটি উপশিরোনামে ঝুঁকিগুলো বর্ণনা করা হয়।
যুক্তরাজ্য সরকারের তৈরি করা ওই নির্দেশনায় বলা হয়, দেশটির রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আধিপত্যনির্ভর। আর এ দুটি দলের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত নাজুক। আবার দল দুটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সাংঘর্ষিক ও অতি কেন্দ্রীভূত।
“ঘুষ-দুর্নীতির পাশাপাশি অবকাঠামো এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় বাধা। ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ঘুষ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বাধা দূর করতে দরকার শুধু সদিচ্ছা ও যথাযথ উদ্যোগ,” প্রতিবেদনটির বক্তব্য প্রসঙ্গে বেনারকে জানান ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরী।
অর্থমন্ত্রীর দাবি, অর্থনীতির শক্তি বাড়লে রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে
তবে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় দুর্নীতি ঠেকানোর সংকল্প থাকলেও আর্থ–সামাজিক প্রেক্ষাপটে তা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দুর্নীতির পাশাপাশি এ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাও অগ্রগতিকে টেনে ধরছে। যদিও এরই মধ্যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় জিডিপির ১ শতাংশ ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করে অথর্মন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ রাজনৈতিক অস্থিরতা চায় না। অর্থনৈতিক শক্তি বাড়লে রাজনৈতিক অস্থিরতা এমনিতেই কমে যাবে।
“রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো করছে। এর পেছনে কারণ হলো—এ দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিযোগিতা করার মনোভাব রয়েছে,” জানান পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
ওই সভায় অংশ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ক্রিস্টিন কাইমস বলেন, “ক্রয় খাতে দুর্নীতি হয়। ই-প্রকিউরমেন্ট পদ্ধতি এ দুর্নীতি কমাতে পারে। তাই আমার সুপারিশ হলো, সপ্তম পরিকল্পনায় এটা থাকা উচিত যে সব ধরনের সরকারি কেনাকাটায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।”
অবশ্য পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্য হচ্ছে, দুর্নীতি কতটা আছে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে দুর্নীতি কমাতে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখি যুদ্ধে নামতে হবে
“রাজনৈতিক শক্তির মহল বিশেষের অংশগ্রহণ নিদেনপক্ষে নিরব সম্মতি ছাড়া দুর্নীতির বিষবাষ্প দীর্ঘদিন চলতে পারে না। রাজনৈতিক কৃতসংকল্পতা ছাড়া দুনীতি প্রতিরোধ বা দুর্নীতি দমন আদৌ সম্ভব নয়,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনের ইশতেহার পূর্ব “দিন বদলের সনদের” উপধারায় সুস্পষ্ট অঙ্গীকার করেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালী করা হবে।
এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ দিতে হবে।
তাঁর মতে, রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের ঘুষ, দুর্নীতি উচ্ছেদ, অনোপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, কালোটাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ছাড়া সরকারি কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারাইজড করে দুর্নীতির পথ বন্ধ করতে পারলে এই আর্থিক ক্ষতি থেকে জাতি রক্ষা পাবে।