এবার ভারতীয় গরু কম, কুরবানিতে ভাগ্য ফেরার আশায় দেশীয় খামারিরা
2015.09.16

কুষ্টিয়ার কুমারপাড়া বিসিক এলাকার গরু খামারি কাজী শওকত। গত বছর কুরবানি ঈদে ঢাকায় ১০টি গরু বিক্রি করতে এসেছিলেন তিনি। সবগুলো গরু ৮২ লাখ টাকায় কিনতেও রাজি হন একটি কোম্পানী। কিন্তু শেষ দিকে বাজারে বিপুল পরিমানে ভারতীয় গরু ঢোকায় শেষ পর্যন্ত গরুগুলো ৩২ লাখ টাকায় বিক্রি করে আসতে বাধ্য হন এই ব্যবসায়ী। বেনারকে তিনি বলেন, “প্রতিটি গরুতে প্রায় নয়শ কেজিরও বেশি পরিমান মাংস হওয়ার কথা। কিন্তু শুধুমাত্র ব্যাংক লোন শোধ করতেই বিরাট অঙ্কের ক্ষতির পরেও গরুগুলো ওই মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলাম।”
এ তো গেল গত ঈদের কথা। আসছে কোরবানী ঈদের বাজারের কথা তুলতেই এক গাল হেসে শওকত বলেন, “এবার তো বাজারে ভারতের গরু কম। তাই লোকসান নিয়ে ভাবছি না। এবার ঈদের হাটে ছোট বড় মিলিয়ে ৩০ টি গরু তুলব। সব মিলিয়ে কোটি টাকারও উপরে মূল্য পাওয়ার আশা করছি। এবার আমাদের মত খামারির মুখে একটু হলেও হাসি দেখবেন।”
ঈদুল আজহায় কোরবানি হওয়া পশুর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না পাওয়া গেলেও ঈদের পর পাওয়া চামড়া গণনা থেকে গত বছর ৩৬ লাখ পশু জবাইয়ের খবর পাওয়া যায়। এসব চাহিদার প্রায় অর্ধেকই আসতো ভারত থেকে। কিন্তু হিন্দু প্রধান দেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশে গরু পাচার বন্ধ করে দেয়। গত এপ্রিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং বিএসএফকে কড়া হুশিয়ারী দিয়ে নির্দেশ দেয় সীমান্তে গরু পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে হবে।
এরপর থেকে ভারত বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ করে । তখন থেকেই এবারের কুরবানি ঈদে গরুর ভাল মূল্য পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে খামারিরা। কারণ, প্রতিবছরই ভারতের গরু আসার কারণে দেশীয় গরুর মূল্য কমে যায়। ফলে খরচটাও উঠে আসতো না ব্যবসায়ীদের।
তাছাড়া ভারতের গরুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে অল্পসময়ে ওষুধের মাধ্যমে গরু মোটা তাজাকরণ করতো এক ধরনের ব্যবসায়ী। সেসব গরু বিক্রি না হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় মারা যেত সেগুলো। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তো খামারিরা। এমন ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তা থেকে কুষ্টিয়ায় কয়েকজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন বলেও বেনারকে জানান খামারি শওকত। তবে তার পরিচিত সেসব ব্যক্তিদের নাম বলতে চাননি তিনি।
‘দেশের গরু দিয়েই চাহিদা পূরণ সম্ভব’
এদিকে ভারত গরু না দিলেও এবারের ঈদে দেশে কোরবানির পশুর সংকট হবে না বলে জানিয়েছে সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, দেশের উৎপাদন দিয়েই এ চাহিদা পূরণ সম্ভব। এরপরেও সামান্য সংকট যদি থাকে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন মিয়ানমার থেকে আসা গরু দিয়ে সে সংকট পূরণ সম্ভব। মিয়ানমার থেকে সামান্য সংখ্যক গরু বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সূত্র।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) হিসাব অনুসারে, প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ গরু ভারত থেকে আনা হত। এ খাতে লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসাবে, ২০১৪ সালে গরু এসেছে ২০ লাখ ৩২ হাজার। ২০১৩ সালে আসে ২৩ লাখ ৭৪ হাজার, অর্থাৎ মাসে প্রায় ২ লাখ করে গরু এসেছে। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে গরু আসা কমতে থাকে।
যেখানে গত জানুয়ারিতে গরু আসে ১ লাখ, সেখানে ফেব্রুয়ারিতে আসে মাত্র ৪৮ হাজার ৪৫০টি, মার্চে আসে ৪৪ হাজার ৯৪৫টি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে ২০ হাজারের বেশি গরু আসেনি। আগস্টে প্রতিদিন মাত্র দুই হাজারের মতো গরু এসেছে। অথচ আগে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ হাজার করে গরু আসতো সীমান্তের ওপার থেকে। এখন সে সংখ্যা আরো কম।
শেষ মুহুর্তে সীমান্ত দিয়ে আসছে ভারতীয় কিছু গরু
ভারত গরু দেওয়া বন্ধ ঘোষণার পর থেকে গরু কম আসলেও ঈদের আগে শেষ মুহুর্তে দেশের বিভিণ্ন সীমান্ত দিয়ে বেশকিছু গরু আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট এলাকার খামারি বা ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা হতাশার সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জয়পুরহাটের গরু ব্যাবসায়ী মোস্তাক আলী বেনারকে জানান, “গত রোববারও চোরাইপথে বেশ কিছু গরু পার হয়েছে। তবে সে সংখ্যা আগের তুলনায় খুবই সামান্য। ঈদের আগে যদি এ সংখ্যা আরো বেড়ে যায় তবে দেশীয় গরু বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েবেন স্থানীয়রা”।
বছর দশেক আগে ভারত থেকে গরু আনতে দুদেশের সীমান্তগুলোতে করিডোর ব্যবস্থা চালু হয়। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলে ১২টি, যশোরে ৯, খুলনায় ৪, সিলেট ও চট্টগ্রামে ৩টি করে মোট ৩১টি করিডোর আছে। এসবের কয়েকটি দিয়েও কিছু কিছু গরু আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
যশোরের নাভারন গবাদি পশু শুল্ক করিডোরের সহকারি রাজস্ব অফিসার মো. নজরুল ইসলাম জানান, সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম পাঁচ দিনে ৩ হাজার ৩ শ ২টি গবাদি পশু করিডোর করা হয়েছে। এর থেকে রাজস্ব এসেছে ১৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
বছরে প্রয়োজন ৫০ লাখ গরু
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ গরু জবাই হয়। ভারত গরু না দেওয়ার ঘোষণার পর থেকেই দেশীয় খামারিদের গরু উৎপাদনে উৎসাহ দিতে থাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। মোটাতাজাকরণ বন্ধেও খামারিদের অনুপ্রাণিত করতে থাকে তারা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে দেশে আড়াই কোটি গরু মজুত আছে। এরমধ্যে গাভী বা বকনা এক কোটি ২০ লাখ। বাকি এককোটি ৩০ লাখ এঁড়ে ও দামড়া। এই এককোটি ৩০ লাখের মধ্যে একবছর বয়সী গরু রয়েছে ৬৫ লাখ। বাকি ৬৫ লাখ কোরবানি করা যেতে পারে, তবে সব গরু বাজারে আসবে না। ৬৫ লাখের মধ্যে ৩০ লাখ গরু বাজারে আসতে পারে।”
প্রতিমন্ত্রী জানান, দেশে বর্তমানে মোট ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা দুই কোটি ৮৮ লাখ। এরমধ্যে ভেড়ার সংখ্যা ৩২ লাখ ও ছাগল দুই কোটি ৫৬ লাখ। ছাগল-ভেড়া বছরে জবাইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে এককোটি ৩৮ লাখ। ৬৯ লাখ ছাগল কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ছাগল, ভেড়ার চাহিদাও দেশীয় উৎপাদন থেকে পূরণ হয়।”
গরু ব্যবসায়ীরা জানান, এর বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ের খামারিরাও এবার ভাল দাম পাওয়ার আশায় ৪-৫ লাখ বিক্রয়যোগ্য গরু বাজারে তুলবে। এ থেকে তারাও আশাবাদি আসছে ঈদুল আজহায় কুরবানি পশুর কোন সংকট বাজারে থাকবে না।
প্রতিবার দেশের কিছু সৌখিন মানুষ উট আমদানি করলেও এবার এই পশুতে মরণব্যাধি মার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের খবরে সে আশাও করছে না ব্যবসায়ীরা।
মিয়ানমার থেকে ঢুকছে গরু
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে মিয়ানমার থেকেও সংখ্যায় কম হলেও কিছু গবাদি পশু আসছে বলে জানিয়েছে কয়েকটি সূত্র। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ করিডোর হয়ে আনা এসব গরু, মহিষ ও ছাগল থেকে সরকার রাজস্বও পাচ্ছে।
শাহপরীর দ্বীপ করিডোর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম জানান, মিয়ানমার থেকে করিডোর পেরিয়ে গরু আসছে। এসব গরুর দাম ভারত থেকে আমদানি করা গরুর চেয়ে কম। টেকনাফ শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির জানান, ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করিডোর হয়ে চার হাজার ১৯৪টি গরু, মহিষ ও ছাগল আনা হয়েছে। এসব পশু থেকে রাজস্ব পাওয়া গেছে ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “ভারত থেকে সামান্য হলেও গরু আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এই ‘না আসা’ বা ‘কম আসা’র খবরে দেশেীয় খামারিদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়েছে। সাধারণত, তারা আভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখেন। স্বাভাবিক মুনাফাও করেন। তবে ভারত গরু দেওয়ার ঘোষণা বন্ধের পর থেকেই দেশে মাংসের দাম বেড়েছে। সেই মূল্য হিসেবে এবার ঈদুল আজহায় তারা ভাল মুনাফা পাবেন”।
তিনি বলেন, সরকার সুবিধা দিলে দেশীয় ব্যবসায়ীরাই আমাদের গরুর চাহিদা মেটাতে পারে। এরজন্য এ খাতে আরো বিনিয়োগ দরকার। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক পশু উৎপাদনে বিশেষ ঋণ সুবিধা চালু করেছে। গরু বাণিজ্যিকীকরণে তা সাহায্য করবে। এছাড়া হাইব্রিড গরু উৎপাদনসহ এ বিষয়ে গবেষণার জন্যও সরকারকে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলেই মাংসের চাহিদা মেটাতে অন্যের মুখাপেক্ষিতা দূর হবে।