বিচারবহির্ভূত হত্যায় সরকারি দলে প্রতিক্রিয়া, বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.08.25
BD-crossfire ১৯ আগষ্ট সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নিহত আরজুর বড় ভাই মাসুদ রানা।
বেনার নিউজ

সরকারি ছাত্রসংগঠনের একজন নেতাকে গত ১৭ আগষ্ট কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার অভিযোগে র‍্যাব ও পুলিশের তিন কর্মকর্তাসহ চারজনের বিরুদ্ধে সোমবার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসেবে, ২০০৪ সালের পর থেকে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে, কিন্তু সরকারি দলের ভেতর প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ঘটনার এই প্রথম।

সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় শেখ ফজলে নূর তাপস বন্দুকযুদ্ধের বিষয়টিকে তথাকথিত গৎ বাঁধা গল্প বলে উল্লেখ করে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।

১৯ আগস্ট আরজুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হাজারীবাগ থানা আওয়ামী লীগের নেতারা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাটিকে ‘কল্পকাহিনী’ বলে আখ্যা দেন। ফজলে নূর তাপসও সাংবাদিকদের সামনে ওই ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলেন।

ছাত্রলীগের হাজারীবাগ থানা শাখার সভাপতি আরজু মিয়াকে অপহরণের পর গুলি করে হত্যার অভিযোগ আমলে নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঢাকার মহানগর হাকিম শাহরিয়ার মাহমুদ আদনান বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন।

আরজুর ভাই যে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তারা হলেন; ওই সময় র‍্যাব-২ এর অধিনায়কের দায়িত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানা, উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) সাহেদুর রহমান, পুলিশের পরিদর্শক মো. ওয়াহিদ ও র‍্যাবের সোর্স রতন।

এদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদ রানাকে রোববার র‍্যাব-২ থেকে সরিয়ে সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

“এখন একজন ম্যাজিস্ট্রেট বাদী ও সাক্ষীদের ডেকে তাদের জবানবন্দি শুনবেন। তার প্রতিবেদন ও সুপারিশের ভিত্তিতে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন- অভিযোগটি মামলা আকারে গ্রহণ করা হবে কি না,” বেনারকে জানান বাদীর আইনজীবী আজিম উদ্দিন।

কোন হাকিম কত দিনের মধ্যে এই তদন্ত করবেন- তা ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম ঠিক করে দেবেন বলে জানান আজিম।

এর আগে গত রোববার নিহত আরজুর ভাই মাসুদ রানা মামলার আরজিতে অভিযোগ করেন, ১৭ আগস্ট হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি আরজু মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে যায় র‍্যাব। তাঁকে হত্যা করে সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেছনে লাশ ফেলে রাখা হয়।

অথচ র‍্যাব ১৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আরজু বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। অভিযোগে আরও বলা হয়, ১৭ ও ১৮ আগস্ট ঘটনাস্থলে কোনো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেনি।

অন্যদিকে চুরির অভিযোগে এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আটক আরজু মিয়া গত ১৭ আগস্ট ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় বলে দাবি করে র‍্যাব।


বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি

ওই ঘটনার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ঘটনাগুলো বিচারবহির্ভূত এবং প্রতিটি ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত বলে মত দিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ।

ক্ষমতাসীন দল ও জোটের মধ্যেও এমন মত জোরদার হচ্ছে। সরকারি দলের অন্তত দুজন সাংসদ প্রকাশ্যেই ‘বন্দুকযুদ্ধে’র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলছেন, এটা মানা যায় না।

“গত কিছুদিনে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের যে প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে মনে হয়, এত বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে তাঁদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় অথবা বোধোদয় হয়েছে,” বেনারকে জানান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল।

তাঁর মতে, সরকারি দলের নেতারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হওয়ার পর মনে হচ্ছে, সবাই এখন ক্রসফায়ারের বানানো গল্পের অবসান চায়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার মতে, ‘ক্রসফায়ারের গল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই আমরা বলে আসছি, আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে রাষ্ট্র সন্ত্রাসের মাধ্যমে সমাজ থেকে সন্ত্রাস নির্মূল করতে পারবে না। যদি তাই হতো, তাহলে গত প্রায় এক যুগে দেড় হাজারের বেশি মানুষ হত্যার পর দেশে সন্ত্রাসী থাকে কীভাবে?’


সরকারী দলেও প্রতিক্রিয়া

সরকারি দলের কিছুসংখ্যক নেতা–কর্মীর বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের কঠোর অবস্থানকে দলের একটি অংশ সমর্থন করলেও মাঠ পর্যায়ে তীব্র আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের একটি অংশের বক্তব্য হচ্ছে, বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা নয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা স্থাপনের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

“২০০৪ সালে বিএনপি ক্রসফায়ারের মাধ্যমে সন্ত্রাসের যে সমাধান খুঁজেছিল, তা এখনো চলছে। আমার মতে, আইনি প্রক্রিয়ায় ও রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে,” বেনারকে জানান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও প্রবীণ সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

আইন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এই সভাপতি বলেন, সুশাসন ও আইনের শাসন সুদৃঢ় হলে, গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ সবার মধ্যে জাগ্রত হলে এবং গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কমে আসবে।

“আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো সমাধান নয়। এতে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হবে,” বেনারকে জানান বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, যিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি।


‘ক্রসফায়ার’ বেড়েই চলছে

দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে নিয়মিত তথ্য প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), অধিকার, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনসহ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন। এসব সংগঠনের তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময় ও এনকাউন্টারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ক্রমাগত বাড়ছে।

আসকের হিসাব হচ্ছে, ২০১৪ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে নিহত হন ১২৮ জন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৭২। এ বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ৮৭। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, চলতি মাসে এ পর্যন্ত আরও অন্তত ১২ জনের নাম যুক্ত হয়েছে এই তালিকায়।

আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রতিটি ঘটনার বিচারবিভাগীয় অথবা নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়ে বলেন, নিরপেক্ষতার স্বার্থে নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

পুলিশ সদর দপ্তরের বক্তব্য

পুলিশ সদর দপ্তরের এক বক্তব্যে গত ২ আগস্ট বলা হয়, ২০১৪ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গেছে ১০২ জন পুলিশ সদস্য। যারা পুলিশের বা সাধারণ মানুষের প্রাণ হরণ করবে, তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটিয়ে আত্মরক্ষার অধিকার স্বীকৃত রয়েছে বাংলাদেশের আইনে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তর এই বক্তব্য দেয়। এতে আরও বলা হয়, ‘আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগে পুলিশের ভূমিকা আইনানুগ কি বেআইনি, সেটা বলার এখতিয়ার রয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালতের।’


স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই র‍্যাবের পক্ষে

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার মধ্যে থাকা র‍্যাবের পক্ষে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, রাষ্ট্রীয় এই বাহিনী আইন অনুসরণ করেই কাজ করছে ।

আরজু মিয়ার মৃত্যুর ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তে আদালতের নির্দেশের পর গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি ।  

আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, “আরজুর মৃত্যুর ঘটনায় র‍্যাব দায়ী কি না, তা এখনই বলা যাবে না। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। আদালত যেভাবে বলবে সেভাবে আমরা কাজ করে যাব।”

এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১৯ আগস্ট বলেছেন, “কয়েকটা বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। সেই বন্দুকযুদ্ধে কয়েকজন মারা গেছে। আমরা কোনো সন্ত্রাসীকে ছাড় দেব না।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।