নিউইয়র্কে ২৪তম আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা অনুষ্ঠিত
2015.05.26

প্রবাসে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চার বিকাশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তি রুখে দেয়া ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারের মধ্যে দিয়ে নিউইয়র্কে ২৪তম আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা শেষ হয়েছে।
জ্যাকসন হাইটসের পিএস-৬৯-এ অনুষ্ঠিত ২২ মে থেকে ২৪ মে তিন দিনব্যাপী এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন নিউইয়র্কসহ আশেপাশের অঙ্গরাজ্য থেকে আসা কয়েক হাজার বাংলাদেশি।
সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস এলাকা পরিণত হয়েছিল উৎসবের নগরীতে। নিউইয়র্কের পুস্তক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা উপলক্ষে নিউইয়র্ক রাজ্য সরকার এবছর উৎসবের তিনদিনকে ‘বাংলা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে।
এর আগে তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। এছাড়াও ঢাকা থেকে উৎসবে যোগ দেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পাল, জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সামিনা চৌধুরীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার গুণী মানুষেরা। এবছর মেলার আহ্বায়ক ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার।
বই মেলায় বাংলাদেশের ১৬টি প্রকাশনী অংশ নেওয়ার পাশাপাশি উৎসবে বিভিন্ন পর্বের আলোচনায় বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ভিয়েনা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কবি-লেখক, সাংবাদিক-শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ-সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক সংগঠকরা অংশ নেন।
বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, প্রাইম ব্যাংক, এবি ব্যাংক, গ্রিনডেল্টা ইন্স্যুরেন্সসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান এই উৎসবে অর্থ সহায়তা দিয়েছে।
এছাড়া উৎসবের বিভিন্ন পর্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার সংকল্পে কবিতা আবৃত্তির পাশাপাশি গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়। সর্বস্তরের প্রবাসীর বিপুল সমাগম ঘটায় এবার সর্বাধিক সংখ্যক বইও বিক্রি হয়েছে বলে জানান উদ্যোক্তা বিশ্বজিৎ সাহা।
অনুষ্ঠানের ২য় দিনে ‘গণহত্যা দেশে দেশে’ বিষয় ভিত্তিক এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পড়েন প্রদীপ রঞ্জন কর, আলোচনা করেন, আহমদ মাঝার ও রামেন্দু মজুমদার।আলো চনায় বক্তারা ২৫ মার্চ কে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সরকারকে জাতিসংঘের ফোরামে উত্থাপনের আহ্বান জানান।
এছাড়াও ছিলো বুদ্ধির মুক্তির আন্দোলন ও মূলধারায় বাংগালী লেখক বিষয়ে আলোচনা, লেখক-প্রকাশক-পাঠক ত্রিমুখী আলোচনা ও নতুন বই-এর মোড়ক উন্মোচন।
‘আগামী দিনের বাংলাদেশ’ বিষয়ে এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন রামেন্দু মজুমদার, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, গোলাম মোর্তুজা ও মোল্লা আমজাদ হোসেন।সঞ্চালক ছিলেন নিনি ওয়াহেদ। বক্তারা বলেন, সরকারের অনেক সাফল্য এবং দেশের অনেক অগ্রগতি সত্তেও সরকারের সমালোচকদের প্রতি অসহিষ্ণু আচড়ন, নাশকতাকারী ও ব্লগার হত্যাকারীদের প্রতি ব্যবস্থা গ্রহন করতে না পাড়ায় দুর্বৃত্তরা বেপড়োয়া হয়ে পড়ছে, বার বার হত্যা ও নাশকতায় মেতে উঠছে।
ব্লগার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের অনীহা কেনো এই প্রশ্নে বেনার নিউজকে সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা বলেন, “সরকার ব্লগারদের পক্ষ নেয়াকে নাস্তিকদের পক্ষ নেয়া মনে করে হয়তো হত্যাকারীদের খুজে বের করতে জোড়ালো অবস্থান নিচ্ছে না। এতে তাদের রাজনৈতিক ক্ষতি হবে মনে করেই চুপ থাকছে”।
একই প্রশ্নে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, “ আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা ব্লগার হত্যার প্রতিবাদ ও সংশ্লীষ্টদের ধরে বিচারের আওতায় আনার দাবী জানিয়ে আসছি। নতুবা একের পর এক লেখক-বুদ্ধিজীবিদের হত্যা চলতেই থাকবে। তালিকা ধরে ধরে তারা খুন করে যাবে আর সরকার বসে থাকবে তা আমরা আশা করি না”।
শেষদিনে ‘মুখোমুখি’ নামে সমাপনী অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতীর পরিচালক রামকুমার মুখোপাধ্যায় একই মঞ্চে দর্শক শ্রোতার মুখোমুখি হন।
যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া বাংলাদেশি প্রজন্মের ব্যাপক অংশগ্রহণকে এবারের ‘বিশেষ দিক’ উল্লেখ করে বিশ্বজিৎ বলেন, “তারা বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের এগিয়ে চলার ঘটনাবলী গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনেছেন। বিভিন্ন আলোচনায় কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করেছেন।”
এছাড়া উৎসবে ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও বৈধভাবে অর্থ প্রেরণ’ শীর্ষক এক আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বীরুপাক্ষ পাল এবং নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান।
আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলা উপলক্ষে তিনদিনের অনুষ্ঠানের শেষ দিনে ছিল আমন্ত্রিত অতিথিতের আড্ডা, শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ, লেখক-প্রকাশ-পাঠক ত্রিমুখী আলাপচারিতা, ছড়া ও স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর, আমন্ত্রিত শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশন, পাবর্ত্য চট্টগ্রামের শিল্পীদের আঞ্চলিক পরিবেশনা, নাটক নিয়ে আলোচনা ও অভিনয়, মূলধারায় বাঙালি লেখকদের আলোচনা, সংস্কৃতিকর্মী সেমন্তী ওয়াহেদের নৃত্য, ব্যান্ড সঙ্গীত ইত্যাদি। মেলায় পাবর্ত্য চট্টগ্রামের চারুশিল্পী যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কেসি মংয়ের চিত্র প্রদশর্নীতে ভিড় ছিল লক্ষণীয়। এছাড়া বই ও বিভিন্ন পণ্যের স্টলেও ভিড় লক্ষ করা গেছে।
প্রবাসের আবৃত্তিকার মুমু আনসারীর সঞ্চালনায় ছড়া পাঠ পর্বে অংশ নেন কবি ও সাংবাদিক দর্পণ কবীর, ফকির সেলিম, প্রকাশক হুমায়ূন কবীর ঢালী, মিজানুর রহমান জোয়ার্দার প্রমুখ। সবশেষে জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সামিনা চৌধুরীর একক সঙ্গীতানুষ্ঠান উপভোগ করেন দর্শক-শ্রোতারা।