আইন হচ্ছে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে, সংশোধন হবে বিতর্কিত ধারার
2015.06.11
মানবাধিকার সংগঠন ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের আপত্তির মুখে সরকার তথ্য প্রযুক্তি আইনের কমপক্ষে তিনটি ধারা সংশোধন বা সংযোজনসহ আইনটি যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ওই আইনের ৪৬, ৫৭ ও ৭১ ধারা ‘বাক স্বাধীনতা পরিপন্থী’ বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ।
ইন্টারনেটের প্রসারের পর ২০০৬ সালে তথ্য প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করে সরকার, যাতে কয়েকটি ক্ষেত্রে অপরাধের জন্য শাস্তির বিধানও রাখা হয়।
২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফায় কয়েকটি ধারা সংশোধন করা হলেও আইনটি এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছেনি বলে এর বিরোধিতাকারীরা অভিযোগ করে আসছেন।
তা ছাড়া আইনটি অনেক ক্ষেত্রে হয়রানি করতে বা ভিন্নমত দমনে ব্যবহার হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই আইনে অপরাধকে অজামিনযোগ্য, ন্যূনতম শাস্তি ৭ ও সর্বোচ্চ শাস্তি ১৪ বছরে উন্নীত এবং জরিমানার অঙ্ক এক কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
“২০০৬ সালে এই আইনটি করার সময় এর ভিন্ন রকম প্রেক্ষাপট ছিল। গত নয় বছরে প্রযুক্তির অনেক পরিবর্তন হয়েছে,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তাঁর মতে, সময়ের পরিবর্তনে আইনের পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। ব্রিটেনেও দুই বছর পর পর আইন রিভিউ করা হয়।
এখনকার আইনের ৪৬ ধারায় বলা আছে-বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, নিরাপত্তা কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নস্যাতের মতো কোনো কিছু প্রকাশ হলে সে তথ্য সম্প্রচারে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারবে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ।
৫৭ ধারায় রয়েছে- ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোনো ব্যক্তির তথ্য যদি নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করে, এতে যদি কারও মানহানি ঘটে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, তা হবে অপরাধ। এর শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা।
এ ছাড়া ৭১ ধারায় অভিযুক্তদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সাইবার ট্রাইব্যুনালকে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
“আইসিটি অ্যাক্টের ৪৬ ও ৫৭ ধারায় বর্ণিত নির্দেশনা ইন্টারনেটে মত প্রকাশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির বিরোধী। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের বাধা,” বেনারকে জানান আর্টিকেল নাইনটিন-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক তাহমিনা রহমান।
“কোনো ব্যক্তি স্বাভাবিক অপরাধ করলে চার বছর দণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু আইসিটি অ্যাক্টে সমান অপরাধ করলে ১৪ বছর কারাদণ্ডের কথা বলা আছে,” ৫৭ ধারায় বর্ণিত দণ্ডের অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে এ কথা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
তাঁর মতে, ওই আইনে নাগরিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। উল্টো পুলিশ যে কাউকে এই আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করতে পারে।
তবে পুলিশের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধপ্রবণতাও বাড়ছে।
আইনজীবীরা বলছেন, ভারতের ২০০০ সালের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৭ ও ৬৬ক ধারার সঙ্গে বাংলাদেশে এই আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার মিল রয়েছে। ওই ৬৭ ধারা কেবল অশ্লীলতাবিরোধী। অথচ তা নকল করতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অশ্লীলতার সঙ্গে মানহানি, নীতিভ্রষ্টতা, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আইনে সবচেয়ে অভিনব ছিল মিথ্যাকে শাস্তিযোগ্য করা।
“২০০ বছর আগেই মিথ্যার জন্য শাস্তির বিধান রহিত হয়ে গেছে। আদর্শলিপি বইয়ে লেখা ছিল মিথ্যা বলা মহাপাপ। এখন পাঠ্যপুস্তকে লেখা উচিত মিথ্যা বললে ১৪ বছর কারাবাস,” জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক।
বেশির ভাগ মামলা প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননাকেন্দ্রিক
তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এখন পর্যন্ত যত মামলা হয়েছে তা প্রধানত প্রধানমন্ত্রীকে অবমাননাকেন্দ্রিক। সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রথম সাজাও ঘটেছে প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে। খুলনার এক সংখ্যালঘু তরুণের প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধুর জন্য ‘অবমাননাকর’ গান তৈরি ও তা প্রচারের জন্য সাত বছর জেল হয়েছে।
২০০৬ সালে বিএনপি প্রতিপক্ষের জন্য গর্ত খুঁড়েছিল। বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ার এর প্রথম শিকার হলেন। এই আইনে প্রথম পেশাদার রাজনীতিক হিসেবে তাঁর বিচার চলছে।
গত বছরের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে মুঠোফোনে কটূক্তি করায় বাবা-ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ‘অপরাধের’ প্রতিকার অন্য আইনে ছিল। মানহানির সাজা সর্বোচ্চ দুই বছর। কিন্তু দুই বছরের সাজা হবে ১৪ বছর।
এর আগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় ইমরান হোসেন আরিফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফেসবুকে আরিফ লিখেছেন, ‘যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক বলা হয়, তাহলে শেখ হাসিনা আমার বোন ও তাঁর ছেলে আমার ভাগ্নে।’
আরিফের বিরুদ্ধে এর আগে যারা চারটি মামলা করে পেরে ওঠেনি, তারাই এবার তাকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ফেলেছে। আইন অনুযায়ী ৩৩ বছরের এই যুবককে ১৪ বছর জেল বা এক কোটি টাকা জরিমানা করা যাবে।
২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়া সফররত একজন শিক্ষক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করায় হাইকোর্ট তাঁকে তলব করেন। তিনি তা অগ্রাহ্য করলে তাঁকে ছয় মাস দণ্ড দেওয়া হয়।
গত বছরের ১৯ আগস্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক উপপরিচালক শামসুজ্জোহাকে ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যের জন্য গ্রেপ্তার করে।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের আগে শেখ হাসিনা সম্পর্কে ‘অশ্লীল ও অবমাননাকর’ উক্তির দায়ে ঢাকার দায়রা আদালত বুয়েটের সাবেক শিক্ষক হাফিজুর রহমান রানাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। ময়মনসিংহের ত্রিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রও একই অভিযোগে জেলে গেছে।
সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে নতুন আইন
অবশ্য সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে আরও একটি নতুন আইন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যেই এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, গত সাত বছরে ইন্টারনেট ব্যবহার দ্রুতগতিতে বেড়েছে। ২০০৮ সালের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখের নিচে। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ কোটিতে। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন বাংলাদেশি ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট করছেন বলে ওই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে।
“ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ বাড়ার পাশাপাশি অপরাধও বাড়ছে। আবার অপরাধের ধরনও পাল্টাচ্ছে, বেনারকে জানান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
“অফ লাইন অপরাধের চেয়ে অনলাইন অপরাধের প্রভাব অনেক বড়। তাই এর শাস্তিও বেশি হওয়া যুক্তিযুক্ত,” যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের গুরুত্ব স্বীকার করে এমন মত দেন জুনাইদ।
তবে আইন প্রণয়ন বা সংশোধন করলেই হবে না, এর সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন তথ্য প্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা।
“সাইবার অপরাধের ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করা যাবে না। একে কঠোর হস্তেই দমন করতে হবে। কিন্তু আইনের অস্পষ্টতার কারণে এর অপব্যবহারের আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি,” জানান শাহদীন মালিক।
“দেশে ডিজিটাল অপরাধ দমন আইন প্রণয়ন করা দরকার। আর বিদ্যমান আইনগুলো বাংলাদেশের জন্য সময় উপযোগী নয়,” বেনারকে জানান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার।