জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে ঢাকা ছাড়লো পাকিস্তানি কূটনীতিক

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.12.23
BD-diplomat জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদকে বাংলাদেশ থেকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
অনলাইন

জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব (রাজনৈতিক) ফারিনা আরশাদকে বাংলাদেশ থেকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বুধবার তিনি ঢাকা ছাড়েন বলে নিশ্চিত করে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্র।

পরে শাহজালাল বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি মো. শহীদুল বেনারকে বলেন, বুধবার বেলা ১টা ৩৫ মিনিটে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পাকিস্তানি ওই কূটনীতিক ঢাকা ছাড়েন।”

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই কূটনীতিককে সরিয়ে নিতে অনানুষ্ঠানিকভাবে চাপ দেওয়ার পরই পাকিস্তান তাকে সরিয়ে নিয়েছে বলে বেনারকে জানায় ঢাকার একটি কূটনৈতিক সূত্র।

কিছুদিন আগে আটক সন্দেহভাজন কয়েকজন জেএমবি সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং ইদ্রিস শেখ নামে একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে পাকিস্তানি এক নারী কূটনীতিকের জঙ্গি যোগসাজশের তথ্য পাওয়ার দাবি করে গোয়েন্দা পুলিশ। বাংলাদেশের মিডিয়াতে তা প্রকাশ হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও পাকিস্তান হাইকমিশনের সমালোচনা করেন। এমন অবস্থায় পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে প্রতিবাদও জানানো হয়। তবে শেষমেষ বিতর্কিত ওই নারী কূটনীতিককে দেশে ফেরত নিয়েছে দেশটি।  

তবে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত জানুয়ারিতে জঙ্গি অর্থায়নে জড়িত সন্দেহে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয় পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা মাযহার খানকে।


খবর ‘কাল্পনিক’ জানিয়ে পাকিস্তানের প্রতিবাদ

এদিকে পাকিস্তানি ওই কূটনীতিকের জঙ্গি যোগসাজশে জড়িত থাকার খবর প্রকাশ হওয়ার পর কড়া প্রতিবাদ জানায় পাকিস্তান। এমনকি এ খবরের জন্য বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি) দায়ী করে দেশটির ঢাকাস্থ  হাইকমিশন।

ঢাকাস্থ পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো প্রতিবাদ লিপিতে বলা হয়, “জানা গেছে, এই ‘কাহিনীটি’ গণমাধ্যমে ফাঁস করেছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। আর গণমাধ্যমের একটি অংশ যাচাই না করেই খবরটি ছাপিয়ে দিয়েছে।”

প্রকাশিত খবরের নিন্দা জানিয়ে এতে বলা হয়, “সব কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও সৌজন্য হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে হোস্ট কান্ট্রিকে (বাংলাদেশ) অস্থিতিশীল করতে অশুভ চক্রান্তের কাল্পনিক এই খবর প্রকাশ করা হয়েছে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, সেই কর্মকর্তার ছবিও গণমাধ্যমে বেপরোয়াভাবে প্রকাশ করা হয়েছে এবং তার চরিত্রে অমার্জিত কটাক্ষ করা হয়েছে। এটা কেবল চরিত্র হত্যার ঘৃণ্য চেষ্টাই নয়, বরং ওই কর্মকর্তার নিরাপত্তাও বিপন্ন করে তুলেছে।”

“ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশে ঘটা সর্বশেষ ঘটনা হোক এটি,” প্রত্যাশা করে পাকিস্তান হাই কমিশন আরো বলে, “একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে পারে, অন্য যে কোনো কিছু তা ব্যাহত করবে।”

তবে পাকিস্তান হাই কমিশনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, “ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সুনির্দিষ্ট কোনো রাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করে বা বাংলাদেশে কর্মরত কোনো ডিপ্লোমেট বা কোনো কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে মিডিয়াতে কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি।”


যেভাবে উঠে আসে ফারিনা’র নাম

গত ২৯ নভেম্বর রাজধানীর উত্তরা ও খিলগাঁও এলাকা থেকে ইদ্রিস শেখ নামের এক ব্যক্তিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, আটকৃতদের মধ্যে ইদ্রিস ও মকবুলের কাছে পাকিস্তানি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে তাদের। এছাড়া ইদ্রিসের কাছে একটি ‘স্পাই মোবাইল’ পাওয়া গেছে; যার মাধ্যমে তিনি দেশের বাইরে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদান করতেন। একটি হাই কমিশনের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গেও তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।”

পরে আটক ইদ্রিস ঢাকার মহানগর হাকিম আব্দুল্লাহ আল মাসুদের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে ওই নারী কর্মকর্তাকে পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদ হিসেবে চিহ্নিত করেন।

ফারিনার সঙ্গে পরিচয়ের বিষয়ে ইদ্রিস বিচারককে বলেন, তিনি ২২ বছর পাকিস্তানে কাটিয়ে বাংলাদেশে ফেরার পর এয়ার টিকেটিং ও ভিসা প্রসেসিংয়ের ব্যবসা শুরু করেন। পরে তার সঙ্গে বাবুল নামের একজনের পরিচয় হয়, যার মাধ্যমে যোগাযোগ হয় কামাল নামের আরেকজনের সঙ্গে।

কামাল তার কাছে নিজেকে ‘পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার লোক’ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। ঘনঘন টিকেট করিয়ে দেওয়ার কারণে বাবুলের কাছে তার অনেক টাকা বাকি পড়ে। এক পর্যায়ে বাবুল পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি ফারিনা আরশাদের মোবাইল নাম্বার দেন। বাবুলের মাধ্যমেই মূলত ফারিনার সঙ্গে পরিচয় হয়।

তিনি বিচারককে বলেন, একবার ৩০ হাজার টাকা দিতে এসে ফারিনা একটি ম্যাজেন্টা রংয়ের গাড়ি নিয়ে বায়তুল মোকাররম থেকে তাকে ফকিরাপুলে নামিয়ে দেন।


দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের জন্য ইতিবাচক

অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও পাকিস্তানি ওই বিতর্কিত কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, কূটনীতিক ফারিনার বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে এই বিষয়ে যাতে আর বিতর্ক না হয় সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে তাকে ফেরত নিয়ে গেছে পাকিস্তান। দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের দিক থেকে বিষয়টি ইতিবাচক।

তবে পাকিস্তান হাইকমিশন বা এই রাষ্টের জঙ্গিবাদি গোষ্ঠীর বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার এই বিতর্ক চলমান থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশটির অতীত, আইএসআই-এর ভুমিকা ইত্যাদি বিষয় থেকে এ সন্দেহকে আরো ঘণিভূত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।