ভোটাধিকার বঞ্চিত দেশের ১৭ লাখ প্রতিবন্ধী
2015.12.02
![BD-disable BD-disable](https://bendev.benarnews.org/bengali/news/BD-disable-12022015132355.html/BD-disable-620-dec2015.jpg/@@images/dbd7cb27-9bea-487c-95ba-022c1828b93d.jpeg)
সাতক্ষীরা জেলার বাসিন্দা হযরত আলী একজন প্রতিবন্ধী। আর এ কারণে কোনবারই ভোটার তালিকায় স্থান পাননি তিনি। অথচ অন্যদের মত নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার তীব্র আকাঙ্খা রাখেন ৩৫ বছর বয়সের এই মানুষটি।
তার বড়ভাই আব্দুর রশিদ বেনারকে বলেন, “হযরতের চলাফেরা স্বাভাবিক নয়। আবার মাঝে মাঝে মানসিকভাবেও সে কিছুটা অসু্স্থ্য থাকে। গ্রামে তাকে সবাই ‘পাগল’ বলেই জানে। একারণে ভোটার তালিকায় তার নাম আসেনি। আর আমরাও চেষ্টা করিনি। তবে নির্বাচন আসলে সে বিভিন্ন সভাসমাবেশে অংশ নেয়।”
এই শুধু হযরত নয়, সারা দেশে তার মত অন্তত ১৭ লাখ তিন হাজার ১৮২ জন বিদ্যমান ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব প্রতিবন্ধীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি ভোটাধিকার প্রয়োগের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) ভোটার তালিকা থেকে এই বিরাট সংখ্যক প্রতিবন্ধী বাদ পড়ার কথা জানিয়েছে।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৫ পৌরসভায় অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে বুধবার ‘বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রতিবন্ধীদের অভিগম্যতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আয়োজন করে ইডব্লিউজি।
সংস্থাটির পরিচালক মো. আবদুল আলিম জানান “বাংলাদেশে ১৮ বছর বা এর চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা এক কোটি ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৫৯১ জন, যার মধ্যে অন্তত ১৭ লাখ তিন হাজার ১৮২ জন বিদ্যমান ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছে।”
মূলতঃ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের কাজ করলেও ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি, নির্বাচনী বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষণা এবং এ বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়ে থাকে ইডব্লিউজি।
ভোট দিতে পারেনি ৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী
২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে শতকরা ৬ ভাগের বেশি প্রতিবন্ধী মানুষ কোনো নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি বলে ইডব্লিউজি’র করা এক জরিপে উঠে এসেছে।
ওই ফলাফল উল্লেখ করে পরিচালক আলিম বলেন, “এদের মধ্যে শতকরা ২২ ভাগ প্রতিবন্ধীকে ভোট কেন্দ্রে যেতে পরিবার থেকে কোনো রকম সহযোগিতা করা হয়নি। দূরত্ব বেশি হওয়ার কারণে শতকরা ১৮ ভাগ কেন্দ্রে যেতে পারেননি। আর পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি না পাওয়ার ভোট দেওয়া হয়নি ১৪ ভাগের।”
নির্বাচনে প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের সুপারিশ
ওই জরিপের সুপারিশ করা হয়, এসব প্রতিবন্ধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রতিবন্ধীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকরি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য নিচতলায় একটি বিশেষ ভোটকক্ষ স্থাপন করার সুপারিশও উঠে আসে। যেখানে প্রতিবন্ধী ভোটারদের পাশাপাশি বয়স্ক ও গর্ভবতী নারী ভোটারদেরও ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে।
এছাড়া সব ভোট কেন্দ্রে র্যাম্প স্থাপন করা, ব্রেইল পদ্ধতির ব্যালট পেপার বাধ্যতামূলক করা, নির্বাচনের দিন প্রতিবন্ধীদের জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করা, যারা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে না তাদের জন্য ঘরে থেকেই ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা এবং ভোটকেন্দ্রের সার্বিক ব্যবস্থাপনা প্রতিবন্ধীবান্ধব করার সুপারিশ করা হয় ওই জরিপ প্রতিবেদনে।
‘দলের পাশাপাশি সব মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চত করতে হবে’
প্রতিবন্ধীদের ভোটাধিকার বিষয়ে সেন্টার ফর ডিজেবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক নোমান খান বলেন, “প্রতিবন্ধীরা সমাজের বাইরের কেউ নয়। আমরা নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের কথা বললেও সব মানুষের অংশগ্রহণের কথা বলি না। আসছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সব দলই অংশ নিতে যাচ্ছে। ওই নির্বাচনে সব মানুষও যাতে অংশ নিতে পারে; সেই ব্যবস্থা করতে হবে। স্বল্প সময়ে পুরোটা হয়ত সম্ভব না হলেও কিছু নতুন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।”
তিনি বলেন, অনেক দেশে শতকরা ৩০-৩৫ ভাগের বেশি মানুষ ভোট দেয় না। এতে অনেকে ভাবতে পারে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী মানুষ ভোট না দিলে কী আসে যায়। বিষয়টা হল কেউ স্ব-ইচ্ছায় ভোট না দিতে পারেন, কিন্তু পদ্ধতির ক্রুটির কারণে কেউ ভোট দিতে না পারার অর্থ তাকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।”
‘প্রতিবন্ধী ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে’
অনেক প্রতিবন্ধীকে ভোটার করা হলেও ভোট দেওয়ার সময় তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় না বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর সার্ভিসেস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজেবিলিটি’র নির্বাহী পরিচালক খন্দকার জহুরুল হক বলেন, “গোপনে ভোট দিতে পারা প্রত্যেক ভোটারের অধিকার। অথচ বর্তমান পদ্ধতিতে একজন প্রতিবন্ধী ভোটাধিকার দিতে পারলেও তার ভোটের গোপনীয়তা অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না। আমাদের মত সমাজে ভোট গোপন না রাখতে পারলে, অনেক সময়ই তা ভোটারের জন্য হুমকির হতে পারে। এটা মাথায় রেখে প্রতিবন্ধীদের ভোটার করার পাশাপাশি তাদের ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।”
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক কোন বক্তব্য না দিলেও বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানান দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।