রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতির তিনটি হিসাব মানতে নারাজ অর্থমন্ত্রী
2015.04.15
জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সাম্প্রতিক তিনটি ক্ষতির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্বব্যাংক, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি, এবং ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এসব হিসাব দিয়েছে।
তাদের পৃথক হিসাব অনুযায়ী, এই ক্ষতির পরিমাণ যথাক্রমে ১৭ হাজার ১৫০ কোটি (২২০ কোটি ডলার), ৪ হাজার ৯০০ কোটি (৬৩ কোটি ডলার) এবং ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা (১৫৪৩ কোটি ডলার)।তিনটি হিসাবের মধ্যে ব্যবধান বেশি হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক উঠেছে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বিশ্বব্যাংকের ক্ষতির হিসাব দেওয়ার দিনই এর সমালোচনা করে সব পরিসংখ্যান উড়িয়ে দিয়েছেন।
এর একদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত তিনমাসের আর্থিক ক্ষতি সরকার পুষিয়ে নিতে পারবে। যদিও প্রধানমন্ত্রী এই ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে কিছুই বলেননি।
বিশ্বব্যাংক বলছে, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকার (প্রায় ২২০ কোটি মার্কিন ডলার) ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে চলতি অর্থবছরে ১ শতাংশ কমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে।
গত ১২ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ পূর্বাভাস দেয় বিশ্বব্যাংক। এর আগে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উৎপাদনে ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে ৫ এপ্রিল তথ্য প্রকাশ করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) দাবি করছে, এই তিন মাসে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এতটা পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে জিডিপির আকার প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হলে চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তব অবস্থা সেটা নয়।
“কিছু ক্ষতি সম্পদের আর কিছুটা উৎপাদনের। সম্পদের ক্ষতি জিডিপিতে হিসাব করা হয় না। বরং উৎপাদনের ক্ষতি হিসাব করা হয়। তাই সিপিডির হিসাব অন্যদের চেয়ে ভিন্ন,” বেনারকে জানান মোস্তাফিজুর রহমান।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক এ প্রসঙ্গে বলছে, প্রতিদিন উৎপাদন খাতে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা হিসাব করেছে তারা। সম্পদের ক্ষতি হিসাব করলে টাকার অংক অনেক বেশি হত।
“আমাদের হিসাবে সম্পদের ক্ষতি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। শুধু পণ্য ও সেবা উৎপাদনে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক,” বেনারকে জানান বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
বিশ্বব্যাংক গত বছরের এপ্রিলে একই প্রতিবেদনে নির্বাচন-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার ক্ষতি অনুমান করেছিল ১১ হাজার কোটি (১৪০ কোটি ডলার) টাকা। ওই সময় হরতাল ও অবরোধ ছিল ৪৫ দিন। চলতি অর্থবছরে হরতাল ও অবরোধ মিলিয়ে মোট ৬০ দিন বিবেচনায় ধরে তারা ক্ষতির অনুমান করেছেন ।
চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মোট বাজেটের আকার ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এফবিসিসিআইয়ের দাবি অনুসারে, টানা অবরোধ-হরতালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা মোট বাজেটের প্রায় অধর্েক।
এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন বলেন, এফবিসিসিআই উৎপাদনের পাশাপাশি সম্পদের ক্ষতিও অন্তর্ভুক্ত করেছে। তার মতে, বর্তমান আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যায় না। এটা অর্থনীতি ধ্বংস করার আন্দোলন।
“দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারলে দেশ দ্রুত ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই একটি চক্র অর্থনীতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে,” বেনারকে জানান কাজী আকরাম।
বিশ্বব্যাংক বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেবাখাতে ৬৮ শতাংশ। আর শিল্পে ২৫ শতাংশ এবং কৃষিতে ৮ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এ হিসাব অনুযায়ী, রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেবা খাতে ১১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা, শিল্পে ৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা এবং কৃষিতে ১ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এ বছর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারত। সংস্থাটি বলেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
তবে এ প্রবৃদ্ধি অর্জনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ব্যাপক অভ্যন্তরীণ চাহিদা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ এবং এক অঙ্কের ঘরে মূল্যস্ফীতির হার থাকতে হবে বলেও মনে করে বিশ্বব্যাংক।
তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, “আমি এটার কোনো দাম-টাম দেই না।”
তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ দাতা সংস্থাগুলো এমনই ভবিষ্যদ্বাণী করে। তারা অলওয়েস রং ইনফরমেশন দেন। তারা এরকম ভুল প্রেডিকশন প্রতিবারই করে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, আশা করছি প্রবৃদ্ধির হার সাত শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। তবে এটাও ঠিক, আমাদের বিদেশি বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। তা নাহলে এর পরিমাণ আরো বেশি হতে পারতো।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, বারবার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার কারণে অর্থনীতিতে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়।
সংস্থাটির মতে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে ইউরো দুর্বল হচ্ছে, এতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক কারখানার পরিবেশ নিয়ে ইমেজ-সংকট রয়েছে।
“কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান হবে। আর বিনিয়োগ আকর্ষণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকতে হবে,” সংবাদ সম্মেলনে জানান বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইউহানেস জাট।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রবৃদ্ধির চাকা আটকে থাকার মূল কারণ বেসরকারি বিনিয়োগে গতি না আসা। বিনিয়োগের জন্য আস্থাশীল পরিবেশ নেই বলে মনে করেন তিনি।
“আমাদের প্রবৃদ্ধিকে আটকে থাকা এ অবস্থা থেকে বের করে আনতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাসহ প্রশাসনিক দক্ষতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে,’’ বেনারকে জানান সিপিডির সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
বর্তমান পরিস্থিতির জন্য রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আতিকুল ইসলাম ।