প্রবাসী আয় অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ হচ্ছে
2016.02.25
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বা সঞ্চয়ন ২৮ বিলিয়ন ডলারের নতুন উচ্চতা ছুঁলেও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিযা আছে। তাঁরা বলছেন, রিজার্ভ বাড়লেও প্রবাসী আয়ের সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম পড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় কমেছে। এর পাশাপাশি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বৃদ্ধি পাওয়ার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে রিজার্ভের ওপর।
এর আগে গত ২৯ অক্টোবর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে ভারসাম্য রাখছে। এর পরিকল্পিত ব্যবহার বাড়লে অর্থনীতি আরও দ্রুত এগিয়ে যেত। এ জন্য সরকারকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
তাঁদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। এর ৮০ ভাগেরও বেশি ব্যয় হচ্ছে দৈনন্দিন খরচ এবং ভোগবিলাসে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রবাসী-আয়ের ৩৯ শতাংশ অর্থই খরচ হয় কেবল পরিবারের খাদ্যের সংস্থানে। আরও ৩৯ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় শিক্ষা, যাতায়াত, কাপড় কেনাসহ নানা ধরনের প্রয়োজনীয় খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে।
বাকি ২২ শতাংশ অর্থের মধ্যে ৫ শতাংশ খরচ হয় টেলিভিশন, ফ্রিজ, মুঠোফোনসহ নানা ধরনের বিলাসপণ্য কিনতে, আর ১৭ শতাংশ দিয়ে কেনা হয় জমি বা ফ্ল্যাট।
প্রবাসী-আয় পায় এমন নয় হাজার ৯৬১টি পরিবারের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এই ফলাফল প্রকাশ করেছে বিবিএস। ২০১২ সালে এসব পরিবার কী পরিমাণ প্রবাসী-আয় পেয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করেছে বিবিএস।
বিবিএস বলছে, মোট রেমিট্যান্সের মধ্যে ৭৪.৬৮ শতাংশই কোনো উৎপাদনমুখী খাতে বিনিয়োগ হয় না। বাকি ২৫.৩২ শতাংশ অর্থ পরোক্ষভাবে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হয়। এর মধ্যে মাত্র ১৭ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় জমি বা ফ্ল্যাট কেনায়। বাকি অর্থ অন্যান্য খাতে খরচ হয়।
“প্রবাসীদের রেমিট্যান্স যদি উৎপাদন খাতে ব্যবহার করা যেত, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে অনেক দ্রুত পরিবর্তন আসত,” বেনারকে জানান সিলেটের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসরিন সুলতানা।
তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা এমন অসংখ্য বাড়ি আছে যেগুলোর মালিক বিদেশে থাকেন। তত্ত্বাবধায়ক বা নিরাপত্তাকর্মীরাই বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। প্রাসাদের মতো এসব বাড়ি দেখতে ভালো লাগলেও এটা অনুৎপাদনশীল খাত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, খাদ্যসহ জীবন নির্বাহে প্রবাসী-আয়ের বেশির ভাগ অর্থ খরচ না করেও উপায় নেই। কারণ, ৭৮ শতাংশ প্রবাসীরই পরিবারের একমাত্র আয়ের উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকায় এসব পরিবার খাবার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতেই প্রবাসী-আয়ের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় করে।
“সাধারণত ধনী পরিবারের সদস্যরা বিদেশে শ্রম দিতে যান না। দারিদ্র্যসীমার কিছু ওপরে থাকা পরিবারের সদস্যরাই বিদেশে গিয়ে মাস শেষে টাকা পাঠান। খাবার খরচসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই পাঠানো সব টাকা খরচ হয়ে যায়,” বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তবে ড. আজিজের মতে, প্রবাসী আয় সরাসরি বিনিয়োগ না হলেও ভোক্তাপণ্যে তা খরচ হচ্ছে। এতে সামষ্টিক অর্থনীতির উপকার তো হচ্ছে।
বিনিয়োগ হচ্ছে কম
এদিকে বিবিএসের সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রবাসী-আয়ের ৭৪ দশমিক ৬৮ শতাংশই বিনিয়োগ হয় না। সমীক্ষা অনুযায়ী, একটি পরিবার বছরে প্রবাসী-আয়ের মাত্র ৫২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। এর মধ্যে সাড়ে ৩৭ হাজার টাকা খরচ হয় ওই প্রবাসীর বাড়িঘর মেরামত ও নির্মাণে। সামাজিক মানমর্যাদার উন্নতির প্রতীক হিসেবেই মূলত বাড়িঘর মেরামত বা নির্মাণ করা হয়।
উল্লেখ্য, ৫২ শতাংশের বেশি প্রবাসীর ঘর কাঁচা। এসব ঘরবাড়ি মেরামত বা পুনর্নির্মাণেই এই অর্থ ব্যয় হয়। আর মাত্র ৫ শতাংশের কিছু বেশি অর্থ খরচ হয় ব্যবসা-বাণিজ্যে।
সমীক্ষা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের লোকজন খাবারের পেছনে সবচেয়ে বেশি, ৪৮ শতাংশ খরচ করেন। এর পরেই রয়েছে সিলেট।
তবে খাবারের পেছনে প্রবাসী-আয় কম খরচ করেন রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। এই অঞ্চলের মানুষ মাত্র ২৪ শতাংশ খরচ করেন খাবারের পেছনে।
অন্যদিকে রংপুরের মানুষ প্রবাসী-আয়ের সবচেয়ে বেশি অংশ বিনিয়োগ করেন। বিবিএস মনে করছে, রংপুরের কিছুটা অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরাই বিদেশে কাজ করতে যাচ্ছেন।
প্রবাসী-আয় পায় এমন পরিবারগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কোনো ধরনের সঞ্চয় করে না। বিদেশ থেকে যে আয় আসে, তার পুরোটাই খরচ করেন এসব পরিবারের সদস্যরা। আর ৫৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করে থাকে। সঞ্চয়ের পরিমাণ বছরে গড়ে ২৭ হাজার ১২৬ টাকা।
তবে সঞ্চয়ের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থই ব্যাংক হিসাবে পড়ে থাকে। সরকারের বিনিয়োগ কর্মসূচিগুলো যেমন-বন্ড, বিমা, সমবায় সমিতি, মেয়াদি আমানত বা এফডিআরে খুব বেশি বিনিয়োগ করেন না তাঁরা।
“দেশের শেয়ারবাজারে টালমাটাল অবস্থা। ব্যাংকে সুদের হার ক্রমেই কমছে। জমির দাম পড়ছে। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার একদফা কমেছে, আরেক দফা কমবে বলা হচ্ছে। এমতাবস্থায় টাকা থাকলেও বিনিয়োগের সুযোগ কম বা ঝুঁকিপূর্ণ,” বেনারকে জানান বাগেরহাটের ফকিরহাট বাজারের বাইসাইকেল বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম, যাঁর এক ছেলে সিঙ্গাপুরে কাজ করেন।
রিজার্ভ ১৫ বছরে ২৭ গুণ
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে প্রায় ২৭ গুণ। গতকাল বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ২৮ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক কাজী ছাইদুর রহমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এর আগের দিন রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির এই পর্যায়ের সঙ্গে ভারতের নব্বইয়ের দশকের মিল খুঁজে পান বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু। সম্প্রতি ঢাকা সফর করা ভারতীয় এই অর্থনীতিবিদ বলেন, “রিজার্ভ ভালো থাকলে স্পেকুলেটররা ভয় পায়। কারণ ওরা জানে সেন্ট্রাল ব্যাংকের হাতে একটা পাওয়ার আছে।”