উন্নয়ন ও বৈষম্য চলছে হাত ধরাধরি করে
2015.07.30
ঢাকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলে এই দেশটিকে কেউ এখন আর দরিদ্র বলে মেনে নেবে না। দামি গাড়ি, বহুতল ভবন ও চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন দেখলে দেশটি সম্পর্কে বহির্বিশ্বের ধারণার সঙ্গে বাস্তবতা মেলানো কঠিন হয়ে যাবে।
চোখে দেখা এই দৃশ্য যেমন বাস্তব, তেমনি রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, জাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো লোকের সংখ্যা এ দেশে বাড়ছে। গণমাধ্যমে ১০ জুলাই ময়মনসিংহে শাড়ি-লুঙ্গি নিতে গিয়ে পদদলনে ২৭ জনের নির্মম মৃত্যুর খবর প্রকাশ হওয়ার পর নিম্ন মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার খবরে যে উচ্ছ্বাস দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল তা অনেকটাই উবে গেছে।
এর পাশাপাশি গত প্রায় দুমাস ধরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সাগরে হাজার হাজার ভাসমান অভিবাসন-প্রত্যাশী মানুষের আহাজারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ দেশে দারিদ্র্য কত প্রকট, কর্মসংস্থানের কী দুরবস্থা।
“দেশের ‘ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের’ দাবি সরকার করে আসলেও প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থা এমনই যে একটি জাকাতের কাপড়ের কাছে মানুষের জীবন তুচ্ছ হয়ে গেছে। এখন দেশে ধনী আরও ধনী এবং গরিব আরও গরিব হচ্ছে,” বেনারকে জানান বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
“সমাজে ক্রমবর্ধমান উৎকট বৈষম্য রেখে দেশ ও সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন বা প্রগতি সম্ভব নয়। সামাজিক বৈষম্য থাকলে কোনো দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করতে পারবে না”, বেনারকে জানান অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন।
তাঁর মতে, ধনী দেশে আয়ের বৈষম্য থাকলেও সামাজিক বৈষম্য নেই। ফলে সেসব দেশের গরিব পরিবারের সন্তানেরাও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে যেতে পারেন।
“আয় বৈষম্য কমলে দারিদ্র্য কিছুটা মোচন হতে পারে। কিন্তু এ দেশে গরিবেরা কখনো মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত হতে পারবে না,” মনে করেন বিনায়ক সেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন, জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বাড়া নিয়ে এক ধরনের স্বস্তি তৈরি হয়েছে সরকারের মধ্যে। কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এটা নিয়ে ততটা সন্তুষ্ট নন।
“দেশের মোট জাতীয় আয় এবং সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয় বাড়লেই সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ে না। অর্থনীতির নিয়ম হচ্ছে, দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তাঁর জন্য এক হাজার মানুষকে গরিব হয়ে যেতে হয়,” লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ গত ৮ জুলাই প্রকাশিত এক লেখায় এই মত দেন।
দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের পরিচয় বন্যা, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও পরিবেশ বিনাশী হিসেবে। কিন্তু এর মধ্যেও দেশটি গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশে সামাজিক সুচকে এখনো ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট।
উন্নয়নের চিত্র
সরকারি হিসেবে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭০ পার হয়েছে। শিশু মৃত্যুর হার ২০০৯ সালে প্রতি হাজারে ছিল ৫০, এখন তা কমে ৪১। সফল হয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি।
শিক্ষার হার ক্রমাগত বাড়ছে। শিক্ষা সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেদের চেয়ে এখন মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, সাত বছরের ওপরে শিক্ষার হার এখন ৫৭ শতাংশ, ১৫ বছরের ওপরে শিক্ষার হার হয়েছে ৬১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় প্রতি মাসে রেকর্ড ভাঙছে। গত জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৫ বিলিয়ন বা এক হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। আগের বছরের একই সময়ে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল এক হাজার ২৯৮ কোটি ডলার।
বহুবিধ সংকটের মধ্যেও বিকশিত হচ্ছে বেসরকারি খাত। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগে অনিয়ম ও অপর্যাপ্ততা থাকলেও তা বাড়ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেক্স রিজার্ভ অ্যান্ড ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তথ্য হচ্ছে, গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে। দেশের রিজার্ভের পরিমাণ এটাই সর্বোচ্চ।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ছাড়াও বেসরকারি খাতে প্রচুর বিদেশি ঋণ আসায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৯০ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩১৪ ডলার হয়েছে বলে গত মে মাসে জানায় পরিসংখ্যান ব্যুরো।
বহুবিধ উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির এসব সংখ্যার আড়ালে আরেকটি চিত্র আছে, যাকে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অর্থনীতির বৈষম্য যা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে দেয়াল গড়ে তুলেছে।
ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের চিত্র
বাংলাদেশে সামাজিক সুচকে এখন ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রকট। খোদ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বিষয়টি উঠে এসেছে।
তাদের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মতো মৌলিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এ দেশে ধনীরাই এগিয়ে রয়েছে। গরিবেরা এসব সুবিধা অপেক্ষাকৃত কম পায়।
বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, এ দেশে সাড়ে ৬৪ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে যায়। সবচেয়ে ধনী এমন ২০ ভাগ পরিবারের ৮১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং সবচেয়ে দরিদ্র এমন ২০ ভাগ জনগোষ্ঠীর শিশুরা কেবল প্রাথমিক শিক্ষায় অংশ নেয়।
আবার ধনী পরিবারের প্রায় ৭৩ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় দক্ষ চিকিৎসা সেবায়। আর দরিদ্র পরিবারের সাড়ে ২৬ শতাংশ শিশুর জন্মের সময় এ সুবিধা মেলে না।
“সামাজিক এ বঞ্চনা শেষ না হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে বৈষম্য কমবে না। ফলে উৎপাদনশীলতা বা আয়ের বৈষম্যও কমবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা থেকে যাবে,” জানান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন।
“গরিবেরা সাধারণত সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যায়। কিন্তু সেখানে নিয়মিত চিকিৎসক থাকেন না, ওষুধও পাওয়া যায় না। অনেক সময় দেখা যায়, চিকিৎসা যন্ত্র আছে, কিন্তু চালানোর লোক নেই,” বেনারকে জানান সামাজিক উন্নয়ন ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ফেরদৌসী সুলতানা ।
তাঁর মতে, শিক্ষার হার কম হওয়ায় গরিবদের মধ্যে সচেতনতাও কম।
“অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। এ বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার সমান সুযোগ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন,” মনে করেন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ মাহবুব হোসেন।
কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে উন্নয়নের যাত্রা শুরু হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল বেশির ভাগ মানুষ পাচ্ছে না।
আবার দেশটিতে কোটিপতির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি ক্রমাগত বাড়ছে অর্থ পাচার। সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে।
জুরিখ থেকে ১৮ জুন প্রকাশিত 'ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৪' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ৪০ দশমিক ৭২ শতাংশ অর্থ বেশি জমা হয়েছে।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ছাড়াও বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাংলাদেশের বিত্তবানেরা টাকা পাচার করছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, দেশে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ১৯৭২ সালে ছিল মাত্র পাঁচজন। ১৯৭৫ সালে ওই সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৭।
সর্বশেষ ২০১৩ সালে ৪৬ হাজার ১৩৫ জন কোটিপতি আমানতকারীর সন্ধান পায় বাংলাদেশ ব্যাংক যা মোট আমানতকারীর ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই হিসাবও বলছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে, ধনীর তালিকাও বড় হচ্ছে। সেই তুলনায় দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা কম।
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বেঁচে থাকলে’ বর্তমানে বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য থাকত না,” মনে করেন অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং ৩৫ শতাংশ মধ্য-মধ্যবিত্ত থাকত।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বেনারকে জানান, “আজকাল অনেকেই বলেন, আমরা ১৯৭১ সালের দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা থেকে উঠে এসেছি। স্বাধীনতার পর অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি বলব, এ সবই ঠিক আছে। কিন্তু ২০১৫ সালে এসে ১৯৭১ সালের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না।”
ওই অর্থনীতিবিদের মতে, “আমরা উল্টো দিকে গিয়ে তুলনা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। মনে করেন আগামীকাল যদি সরকার সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে পড়ে তাতেও কিন্তু আমাদের অর্থনীতি থেমে থাকবে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ থেমে থাকবে না। ফলে যেখান থেকে এসেছি সেটা বড় প্রশ্ন নয়, যেখানে যেতে চাই সেটাই বড় বিষয়।”
তাঁর মতে, অর্থনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে যেমন শঙ্কা থাকবে, তেমনি উৎসাহ বা অর্জনও থাকবে। মূল্যায়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে আমরা সঠিক পথে আছি কিনা।