ছিটমহলের বাসিন্দারা ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ উদ্‌যাপনে প্রস্তুত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.07.30
BD-encleves ছিটমহল বিনিময়ের আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে নীলফামারী জেলার ডোমারের একটি ছিটের অধিবাসীরা একত্রিত হয়েছেন। ৩০ জুলাই,২০১৫
বেনার নিউজ

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কর্মসূচি না থাকলেও ছিটমহলের বাসিন্দারা ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। কাল ৩১ জুলাই মধ্যরাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২ টি ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে দুটি দেশই পৃথকভাবে গেজেট নোটিশ জারি করবে। বাংলাদেশের পক্ষে ভূমি মন্ত্রণালয় একটি গেজেট নোটিশ দিয়ে যেসব এলাকা বাংলাদেশের ভূখণ্ড বলে গণ্য হবে তা জানিয়ে দেবে। অনুরূপভাবে ভারতও নোটিশ জারি করবে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের স্বীকৃতি পাচ্ছে, ওই সব ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য জায়গা বরাদ্দসহ নানাভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে তা উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি চলছে।

ঢাকা থেকে ছিটমহল এলাকায় যাওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, কোথাও শামিয়ানা টানানোর কাজ চলছে। আবার কোথাও চলছে কাঠ পাটাতন দিয়ে মঞ্চ তৈরির কাজ। দিনরাত খেটে এভাবেই এখন উৎসবের প্রস্তুতিতে মেতেছে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলের মানুষজন।

বিগত ৬৮ বছর ধরে নাগরিকত্বহীন অবস্থায় থাকা এখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই এ দিন রাতে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে এত দিনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দে মেতে উঠবেন।

“দুই দেশের ছিটমহলগুলোতে চলবে নানা ধরনের গান-বাজনাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। স্থানীয় মন্দির, মসজিদ ও গির্জাতেও চলবে প্রার্থনা,” টেলিফোনে বেনারকে জানান দীপ্তিমান সেনগুপ্ত, যিনি ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক।

তিনি বলেন, “দুই পারের ছিটমহলেই আমাদের অনুষ্ঠান করা হবে। ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার মশালডাঙ্গাতে করা হবে মূল অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে তথ্যচিত্রের মাধ্যমে ছিটমহলের অতীত ইতিহাস, সেখানকার জীবনযাত্রা, আন্দোলনের কাহিনী তুলে ধরা হবে।”

দুই দেশ যখন শুক্রবার মধ্যরাত থেকে ছিটমহল বিনিময় করবে তার আগে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকায় দুই দেশের হাইকমিশনাররা ৩০ টি গুচ্ছ মানচিত্রে সই করেন। মানচিত্রগুলোতে সইয়ের মাধ্যমে এখন দুই দেশের ১১৪৫টি মানচিত্রের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলো সই শেষ হলো। মুহুরির চর নিয়ে অবশিষ্ট গুচ্ছ মানচিত্রে ভূমির পরিমাণ দুই কিলোমিটার।

’৭৪-এর স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড এবং ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহল ভারতের ভূ-খণ্ড হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। ছিটমহল বিনিময়ের পর স্থলভাগেও বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড বাড়বে। সঙ্গে বাড়বে দেশের নাগরিকের সংখ্যা।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার আলাদা-আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশে নতুন ভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হচ্ছে। ভারতে একইভাবে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

“পরিকল্পনা অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের সব কাজ এগোচ্ছে,” বেনারকে জানান পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক।

তিনি বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হলেও এর অন্য দুই উপাদান অপদখলীয় ভূমি বিনিময় ও সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমান্ত চিহ্নিত করার কাজও চলছে।

বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে যারা ভারতে ফিরে যেতে চান ( তালিকায় নাম দেওয়া ৯৭৯ জন) তারা ছাড়া বাকি সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।

অন্যদিকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ৫১ টি ছিটমহলের লোকজন পাবেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। আগামী ১ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভারতের পূর্ববর্তী ১১১ টি ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।

বাংলাদেশে ভারতের ১ লাখ ৭ হাজার ১৬০ একর আয়তনের ১১১টি ছিটমহল এবং ভারতে বাংলাদেশের ৭ হাজার ১১০ একর আয়তনের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে।

ভারতে সবগুলি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশে ছিটমহলগুলো পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায় অবস্থিত।

এ ছিটমহলগুলিতে ২০১১ সালে একটি যৌথ জরিপ চালানো হয় এবং ১৬২ ছিটমহলে ৫১ হাজার ৫৪৯ অধিবাসীকে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় বাংলাদেশে অবস্থিত ছিটমহলগুলিতে বাস করে এবং ১৪ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি ভারতের ছিটমহলগুলিতে বাস করে।



পঞ্চগড় থেকে আরও ৪৫ জন ভারতে যাচ্ছেন

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার কোটভাজনী ছিটমহল থেকে নতুন করে ১৪টি পরিবারের ৪৫ জন সদস্য ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পঞ্চগড় ও ভারতের কোচবিহার জেলার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

ভারতে যাওয়ার আবেদনের সময়সীমা ১৬ জুলাই শেষ হয়ে গেলেও কোটভাজনী ছিটমহলের ১৬টি পরিবারের ৫৯ জন সদস্য ২০ জুলাই ভারতে যাওয়ার আবেদন করেন। গতকাল কোটভাজনী ছিটমহলের নতুন বাজারে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৪৮ জনের আবেদন গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।

“এখানে আমরা অনেক সময় সুবিচার পাই না। সে জন্যই ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” জানান কোটভাজনী ছিটমহলের বাসিন্দা কমলেশ্বর রায় ও তাঁর স্ত্রী অনিতা রাণী।

অবশ্য ভারতে যাওয়ার আবেদন করে আবার আবেদন প্রত্যাহার করার ঘটনাও ঘটছে। জেলায় এ পর্যন্ত মোট ৪৬৭ জন ভারতে যাওয়ার আবেদন করেন। এদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত চারজন ভারতে যাওয়ার আবেদন প্রত্যাহার করেন।

“এখানে আমাদের অনেক জমিজমা রয়েছে। তা ছাড়া এখানে তো আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। স্থানীয় মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের সম্পর্ক খুবই ভালো। সে জন্যই আমরা ভারতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বেনারকে জানান ভারতে যেতে অনিচ্ছুক বিজয় চন্দ্র বর্মণ।

প্রসঙ্গত, দুই দেশের স্থল সীমান্ত সুরাহার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্থল সীমান্ত চুক্তিতে সই করেন। বাংলাদেশ ওই বছরই চুক্তিটি সংসদে অনুসমর্থন করলেও ভারত সেটি করেনি।

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন ভারতের সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাসে ব্যর্থ হয়।

এবার নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত মে মাসে সর্বসম্মতভাবে ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হয়। অবসান ঘটে দীর্ঘ ৪১ বছরের অপেক্ষার।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।