নানা বাঁধার মুখে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ও অনলাইন পত্রিকা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.12.01
BD-facebook ফেসবুক সহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম খুলে দেয়ার দাবি উঠেছে।
বেনার নিউজ

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে সরকার যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সরকারেরই কিছু কাজকর্মে তথ্যপ্রযুক্তি বিরোধী কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করছেন এই খাত সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশে ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক গণমাধ্যম বন্ধ করা নিয়ে যখন প্রতিক্রিয়া চলছে, তখনই আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) গতকাল মঙ্গলবার জানিয়েছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নয়ন সূচকে একধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ ।

এই অগ্রগতি যেমন আছে, তেমনি অনলাইন পত্রিকাগুলো নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নিয়ে উদ্বিগ্ন তথ্যপ্রযুক্তি খাত সংশ্লিষ্ট অনেকেই। সরকার এ ধরনের পত্রিকাগুলো নিবন্ধন করার নির্দেশ দিয়ে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে।

এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক ও গণমাধ্যমের মালিকেরা ক্ষুব্ধ। গতকাল মঙ্গলবার তাঁরা তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, পাঠকই এসব অনলাইন পত্রিকার ভবিষ্যৎ ঠিক করবে।  

উল্লেখ্য, দেশে প্রায় ১০ হাজার অনলাইন পত্রিকা রয়েছে, যদিও এর সঠিক পরিসংখ্যান তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছেও নেই।

গত কয়েক মাসে অনলাইন পত্রিকা নিয়ে সরকারের প্রথম সমালোচনার বিষয় ছিল এগুলোর সংখ্যা নিয়ে, দ্বিতীয় সমালোচনা এ ধরনের পত্রিকার অপসাংবাদিকতা নিয়ে।

কিন্তু সংখ্যা নিয়ে উদ্বেগের বিষয়টি মানতে নারাজ গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, গণমাধ্যম যত বেশি হোক না কেন, এর ভবিষ্যৎ দর্শক, শ্রোতা ও পাঠকের কাছে।

গত ২৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু জানান, দেশে দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষাণ্মাসিক পত্রিকার সর্বমোট সংখ্যা ২ হাজার ৮১০টি। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত সরকার ৬৮৬টি পত্রিকার নিবন্ধন দিয়েছে।

সংসদে দেওয়া মন্ত্রীর ওই তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ৩১টি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ২৪টি এফএম বেতার ও ৩২টি কমিউনিটি রেডিওর লাইসেন্স দিয়েছে। এর আগে সরকারি খাতে তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল এবং বেসরকারি খাতে ২৩টি টেলিভিশন চ্যানেল, ১৪টি এফ.এম বেতার এবং ১৫টি কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশে এত গণমাধ্যমের প্রয়োজন আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের।এর মধ্যে নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে অনলাইন পত্রিকাগুলো, যেগুলোর বেশির ভাগই কুটিরশিল্পের মতো এগিয়ে চলছে।  


তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি

১৬৭টি দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সূচক প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের টেলিকমিউনিকেশন-ভিত্তিক সংস্থা আইটিইউ। ২০১০ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তির এ সূচক (আইডিআই র্যাংক) অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ চার ধাপ এগিয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৮।

এ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৪ তম, যা ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছিল ১৪৫ তম।

আইটিউয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে ৩২০ কোটি মানুষ এখন অনলাইনের আওতায় চলে এসেছে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া মোবাইল সাবসক্রিপশন বা গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৭১০ কোটিতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, বিশ্বের ৯৫ শতাংশ মানুষ মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে এসেছে।

আইটিইউয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে ১৬৭টি দেশ নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে এসে সব দেশই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে এগিয়েছে। এর মধ্যে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো বেশি উন্নতি করেছে।

এ অঞ্চলের দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, জাপানের মতো ছয়টি দেশ শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।

তালিকায় সবচেয়ে কম ইন্টারনেট সুবিধায় থাকা দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান পড়ে গেছে। ১৬৭টি দেশের মধ্যে তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ড।


প্রসঙ্গ অনলাইন পত্রিকার নিবন্ধন

সম্প্রচার কমিশন এবং অনলাইন নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত অনলাইন পত্রিকার নিবন্ধন কার্যক্রম স্থগিত রাখার প্রস্তাব করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের কয়েকজন সম্পাদক। একই সঙ্গে তাঁরা ছাপা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের জন্য আলাদা নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই বলেও মত দিয়েছেন।

১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে অনলাইন পত্রিকা ও ছাপা পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের নিবন্ধন করতে বলেছে তথ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে গণমাধ্যমের মালিক ও প্রকাশকদের মধ্যে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে গতকাল মঙ্গলবার মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।

সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেন, “শৃঙ্খলার নামে আমরা শৃঙ্খলিত হতে চাই না।”  তাঁর মতে, নীতিমালা করার মধ্যে গৌরবের কিছু নেই। দায়বদ্ধতা থাকলে নীতির দরকার হয় না।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তি এমন পর্যায়ে গেছে যে এর রাশ টেনে ধরে এটাকে শৃঙ্খলিত করা যাবে না।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, “আগে সম্প্রচার কমিশন ও অনলাইন নীতিমালা করেন, তারপর নিবন্ধনের উদ্যোগ নেন।” তাঁর মতে, নীতিমালা ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রণের আবহ লক্ষ করা যায়।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, “ছাপা পত্রিকায় কোনো ভুল হলে এর দায়দায়িত্ব যেমন ওই পত্রিকার প্রকাশক বা সম্পাদকের, তেমনি ওই পত্রিকার অনলাইন সংস্করণের যেকোনো ভুলের দায়দায়িত্বও তাঁদের।”

তিনি প্রশ্ন রাখেন, ছাপা পত্রিকা যদি নতুনভাবে নিবন্ধন করে, তাহলে সেগুলোর দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ কি আগের চেয়ে বাড়বে? তবে যেসব অনলাইন পত্রিকা কোথাও নিবন্ধিত নয়, তাদের জন্য নিবন্ধন হতে পারে বলেও তিনি মত দেন। তিনি বলেন, তাঁর মনে হয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নয়, এই নীতিমালা নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ওই সভায় অংশ নিয়ে বলেন, যেকোনো খবর অনলাইনে প্রকাশিত হলে তা এই নীতিমালায় পড়বে, যা নিয়ে বিভ্রান্তির যথেষ্ট সুযোগ থাকবে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান ধর্মীয় অনুভূতি, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা, দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়গুলো আরও সুস্পষ্ট করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, এটা না করা হলে বহুমাত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হবে।


বাংলাদেশের প্রস্তাবে ফেসবুকের সাড়া

বাংলাদেশের আলোচনার প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক কর্তৃপক্ষ । ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের চিঠি পাঠানোর পরদিনই ই-মেইলের মাধ্যমে উত্তর পাঠিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে আলোচনায় বসার আগ্রহ দেখিয়েছেন তাঁরা। গতকাল মঙ্গলবার ফেসবুকের পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর (ভারত, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া) আঁখি দাশ ই-মেইলে বাংলাদেশের প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের চিঠির জবাব দিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

ই-মেইলে পাঠানো জবাবে আগামী ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে এসে এ আলোচনায় বসার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন তারা। কিন্তু মন্ত্রণালয় চাইছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই বৈঠকের তারিখটি নির্ধারণ করতে। বুধবার এ বিষয়ে আরেকটি চিঠি পাঠাবে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ।

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ফেসবুকের মাধ্যমে নারীর প্রতি হয়রানি, ধর্মীয় উসকানি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো ঠেকাতে ফেসবুকের সঙ্গে চুক্তি করার লক্ষ্যে বিশদ আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে গত সোমবার ফেসবুকের এশিয়া-প্যাসিফিক কার্যালয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে চিঠি পাঠানো হয়।

এতে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফেসবুকের নানা ধরনের অপব্যবহারসহ নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।




মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।