শুভেচ্ছার নিদর্শন ‘দেবদাস’-এর বিনিময়ে কয়েকটি চলচ্চিত্র পাচ্ছে বাংলাদেশ
2015.08.21
ভারতের জাতীয় ফিল্ম আর্কাইভের হাতে ১৯৩৫ সালে নির্মিত প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’ এর কপিটি দেওয়ার বিনিময়ে বেশ কয়েকটি দুর্লভ চলচ্চিত্র পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এগুলি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম: দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’, ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ‘বিশ্বমঙ্গল’ এবং ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ সহ এক ডজনেরও বেশি ছবি। এই বিনিময়কে উভয় দেশ ‘শুভেচ্ছার নিদর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
১৯৩৫ সালে প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত বাংলা ‘দেবদাস’-এর কপি ভারতের সংগ্রহে ছিল না। ১৯২৮ সালে নির্মিত দেবদাসের একটি নির্বাক ছবি ভারতের কাছে রয়েছে। কিন্তু পিসি বড়ুয়া দেবদাসের প্রথম যে সবাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, সেটি বাংলাদেশের কাছেই ছিল। গত প্রায় ৩০ বছর ধরে ওই ছবিটির খোঁজ করছিল দ্য ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া (এনএফএআই)।
নয়াদিল্লী থেকে ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানায়, ১৭ আগস্ট সোমবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মরতুজা আহমদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল পুনের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষের হাতে প্রমথেশ বড়ুয়া অভিনীত এবং পরিচালিত বাংলা ‘দেবদাস’ সিনেমার ডিভিডি তুলে দিয়েছেন।
ওই সংবাদে বলা হয়, ১৯৩৫ সালে নির্মিত প্রথম সবাক বাংলা ‘দেবদাস’-এর ডিভিডি কপি প্রাপ্তির মাধ্যমে অপূর্ণতা ঘুচলো পুনে ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়ার ।
“ভারতীয় ফিল্ম আর্কাইভের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং আমাদের সংগ্রহের জন্য এই চলচ্চিত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল,” গত ১৮ আগস্ট ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একথা জানান ভারতীয় ফিল্ম আর্কাইভের পরিচালক প্রকাশ মাগদুম।
দেবদাস নির্মাণের ইতিহাস
এনএফএআই এর কাছে ১৯৩৫, ১৯৫৫, ২০০২ এবং ২০০৯ সালে হিন্দি ভাষায় এবং ১৯৫৩ সালে তেলেগু ভাষায় ‘দেবদাস’ এর কপি রয়েছে। বাংলা ভার্সন পাওয়ার পর এনএফএআই আরও সমৃদ্ধ হলো।
দেবদাস অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে রচিত। আর ১৯৩৫ সালের প্রথম সবাক বাংলা ‘দেবদাস’-এ পিসি বড়ুয়া নিজেই দেবদাস এবং তার স্ত্রী যমুনা বড়ুয়া পার্বতী (পারু) হিসেবে অভিনয় করেন। আর চন্দ্রাবতী দেবী এতে চন্দ্রমুখীর চরিত্রে অভিনয় করেন।
শরৎচন্দ্র ১৯০১ সালে দেবদাস লিখেন এবং তা ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়। আর বাংলা, অসমিয়া আর হিন্দির পাশাপাশি দেবদাস নির্মিত হয়েছে তেলেগু, তামিল ও উর্দু ভাষায়।
বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে সাদাকালো দেবদাস চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন প্রখ্যাত পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। এতে অভিনয় করেন প্রয়াত অভিনেতা বুলবুল আহমেদ ও কবরী সারোয়ার ও আনোয়ারা।
এরপর ২০১৩ সালে দেবদাস গল্পের অনুকরণে চাষী নজরুল ইসলাম বাংলায় আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটি বাংলাদেশে নির্মিত দেবদাস গল্পের দ্বিতীয় সংস্করণ এবং বাংলাতে প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র সংস্করণ।
এতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের তারকা অভিনেতা শাকিব খান, গল্পের চন্দ্রমুখী ও পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় দুই অভিনেত্রী মৌসুমি ও অপু বিশ্বাস।
বাংলাদেশ যেসব চলচ্চিত্র পেতে যাচ্ছে
তথ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত সোমবার মহারাষ্ট্রের পুনেতে অবস্থিত ভারতীয় ফিল্ম আর্কাইভে আয়োজিত এ বিনিময় অনুষ্ঠানে আর্কাইভের পরিচালক প্রকাশ মাগদুম এক ডজনেরও বেশি চলচ্চিত্র ভারত সফররত বাংলাদেশের তথ্য সচিব মরতুজা আহমদের হাতে তুলে দেন।
মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক প্রমাণ সংবলিত এসব চলচ্চিত্র ‘শুভেচ্ছার নিদর্শন’ ও ‘বিনিময় স্মারক’ হিসেবে বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯১৩ সালে দাদাসাহেব ফালকে পরিচালিত উপমহাদেশের প্রথম নির্বাক পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’, ১৯৩১ সালের সবাক চলচ্চিত্র অমর চৌধুরী পরিচালিত জামাইষষ্ঠী এবং সুখদেব সিং পরিচালিত ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম: দ্য স্টোরি অব বাংলাদেশ’।
এই প্রামাণ্যচিত্রটি ১৯৭২ সালের ২১ অক্টোবর জাপানে মুক্তি পেয়েছিল।
তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভারত থেকে নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের ছবি ‘বিশ্বমঙ্গল’, ঋত্বিক ঘটকের ‘দুর্বার গতি পদ্মা’, আরদেশি ইরানি পরিচালিত ১৯৩১ সালে মুক্তি পাওয়া সবাক চলচ্চিত্র ‘আলমআরা’ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হচ্ছে গিরিশ চন্দ্র ঘোষের লেখা ১৯৩৪ সালের ছবি ‘ধ্রুব’। ছবিটির গান লিখেছিলেন এবং সংগীত পরিচালনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। ছবিতে দেবর্ষি নারদের চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁদের কাছে এই ছবির দুটি রিল রয়েছে। ভারতের কাছে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রটি চেয়েছে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ।
“শেষ নাগাদ বাংলাদেশের ঝুলিতে কোন কোন দুর্লভ চলচ্চিত্রের কপি আসছে, তা চূড়ান্তভাবে জানা যাবে ভারতে সফররত বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ফিল্ম আর্কাইভের মহাপরিচালক বাংলাদেশে ফিরলে,” জানান তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
এই বিনিময় অব্যাহত রাখার প্রত্যাশা
“বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ এবং বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)-এর উন্নয়ন এবং ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তথ্য সচিবের এই সফর,” বেনারকে জানান তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদের একান্ত সচিব মো. আখতারুজ্জামান।
তিনি বলেন, তথ্যসচিব এনএফএআই, পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এফটিআইআই),পশ্চিমবঙ্গের সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট (এসআরএফটিআই)-এর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
“বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের আকাল পড়ছে বলা চলে। ভারত এক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে। তাই দুই দেশের মধ্যে চলচ্চিত্র বিনিময়, এ বিষয়ক চুক্তি ও সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে,” বেনারকে জানান সালেহা বেগম (৪০), যিনি ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক এবং দুই দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন।
তাঁর মতে, কয়েকটি চলচ্চিত্র বিনিময় করেই যেন দুই পক্ষের আগ্রহে ভাটা না পড়ে। এই প্রক্রিয়াটি যাতে সচল ও কার্যকর থাকে, সেদিকে নজর রাখতে দুই পক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান ওই চলচ্চিত্রপ্রেমী।