সাংবাদিক গ্রেপ্তারের ঘটনায় জনমত ৫৭ ধারা বাতিলের পক্ষে
2015.08.21
গণজাগরণ মঞ্চ গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে প্রতিবাদী সমাবেশ আয়োজন করে যেখানে ব্লগার, মুক্তচিন্তার নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষার্থী অংশ নেন। এই সমাবেশ ছিল সাংবাদিক প্রবীর শিকদার জামিনে মুক্তি পাবার পরদিন। যেখানে কারামুক্তি প্রাপ্ত প্রবীরও উপস্থিত ছিলেন।
গত সপ্তাহে রোববার প্রবীরকে গ্রেপ্তা্রের পর ব্যাপক প্রতিবাদ ও সমালচনার প্রেক্ষিতে গতকাল বৃহস্প্রতিবার জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। এরপর তার মামলা প্রত্যাহার ও তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। তারা ওই ধারার মাধ্যমে মুক্তচিন্তায় নিয়ন্ত্রণ আরোপের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখছেন ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে।
সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা ‘প্রশাসনের মিথ্যাচার, জনগণের হাহাকার’; ‘৫৭ ধারা বাতিল কর, প্রবীর সিকদারকে মুক্ত কর’; ‘মুক্ত চিন্তায় হামলা, রুখে দাঁড়াও বাংলা’—ইত্যাদি বলে স্লোগান দেন।
উল্লেখ্য, এই প্রথম বাংলাদেশে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়েছে, যে মামলা দায়েরের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আইনজীবী ও সাংবাদিকেরা।
তবে ওই আইনের ভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে, যিনি সরকারবিরোধী বলে পরিচিত। একাধিক মামলায় মাহমুদুর রহমান ২০১৩ থেকে জেলে আছেন।
সম্প্রতি সরকারবিরোধী বলে পরিচিত আরেক সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁর বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোসহ নাশকতার আটটি মামলা দিয়েছে পুলিশ। এর প্রতিবাদে সরকারবিরোধী সাংবাদিকেরা ক্ষুব্ধ, মাঝেমধ্যে আন্দোলন করছেন তাঁরা।
কিন্তু প্রবীর সিকদার সরকার সমর্থক বলে পরিচিত এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লিখে ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলায় এক পা হারানোর ঘটনায় তিনি জাতীয় পর্যায়ে বিশেষভাবে পরিচিত।
‘৫৭ ধারা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক’
“সংবিধানের ৩৯ নম্বর ধারায় বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। অথচ ৫৭ ধারায় বাক স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক,” জানান গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার।
তিনি অবিলম্বে ৫৭ ধারা বাতিল ও সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের নামে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, ভারতেও ৬৬ (ক) ধারা নামে এমন একটি আইন ছিল, যা বাক স্বাধীনতার পরিপন্থী হওয়ায় তাদের সুপ্রিম কোর্ট এটি বাতিল ঘোষণা করেছে।
“আমাদের আজকে ভাবতে হবে—আমরা কি সামনে এগোব, না ভিন্নমতকে, সমালোচনাকারীকে দমন করতে এমন কালো আইন করব; যাতে সরকারের বিরুদ্ধে বা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলবার সাহস না পায়,” জানান ইমরান।
প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার ও জামিন
ফেসবুকে নিজের জীবন সম্পর্কে শঙ্কা প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দেওয়ার ‘অপরাধে’ সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছিল, যাঁকে অজামিনযোগ্য মামলায় আন্দোলনের মুখে আদালত জামিন দেন গত বৃহস্পতিবার।
প্রবীর তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১০ আগস্ট বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামে দেওয়া স্ট্যাটাসে তিনি তার মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন এমন তিনজনের নাম উল্লেখ করেন।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন- “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবনের শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন: ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে মুসা বিন শমশের ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিনজনের অনুসারী-সহযোগীরা ।”
“আমার ভাই এখন সবার ভাই হয়ে উঠেছে, এটা ভাবতে খুব ভালো লাগছে। তবে তাঁকে আর হয়রানি না করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানাই,” শাহবাগের প্রতিবাদ সমাবেশে জানান প্রবীর সিকদারের ভাই পীযূষ সিকদার।
ব্লগাররা স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পারছে না
“দেশে এখন মুক্তচিন্তার আকাল চলছে। ব্লগাররা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছেন না। কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন, কেউবা চেষ্টা করছেন। এটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে চলতে পারে না, বেনারকে জানান ব্লগার বাকি বিল্লাহ।
এদিকে সরকারকে উদ্দেশ করে ইমরান এইচ সরকার বলেন, ‘প্রবীর সিকদারের নামে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিয়ে আপনারা প্রমাণ করুন, তাঁর সঙ্গে করা অন্যায়কে আপনারা প্রশ্রয় দেননি, আপনারা মত পাল্টেছেন।’
“আমার মুক্তির জন্য যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ। আমাকে যে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, ওই ধারা বাতিলের দাবি জানাই,” সমাবেশে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় বলেন প্রবীর সিকদার।
কী আছে আইনের ৫৭ ধারায়?
আইনের এই ধারায় (৫৭ এর ১) বলা হয়েছে—‘কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।
(দুই) কোনো ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
“এত দিন আমরা বলছিলাম, এই আইনের অপব্যবহার হওয়ার বড় ঝুঁকি রয়েছে। সেই শঙ্কাই সত্য হয়েছে প্রবীরকে গ্রেপ্তার করায়,” বেনারকে জানান আইনজীবী সারা হোসেন।
তাঁর মতে, ক্ষমতাবানেরা এই আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন, এটাই স্বাভাবিক।