পোশাক রপ্তানি করে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করার নতুন লক্ষ্য

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.08.11
BD-garments পোশাক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটলেও বকেয়া বেতন না দেয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে। আগষ্ট,২০১৫
বেনার নিউজ

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর উদ্‌যাপন হবে আগামী ২০২১ সালে। ওই বছরই দেশবাসীকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৫০ বিলিয়ন বা পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার উপহার দিতে চায় পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, যা প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার সমান।

গত বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অ্যাপারেলস সামিটে ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ১৫০ কোটি ডলার।

এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে পোশাকশিল্পের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত এবং এগিয়ে যাওয়ার কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে  বিজিএমইএ। উল্লেখ্য, রোডম্যাপটি গত ৬ আগষ্ট চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ হোটেলে অনুষ্ঠিত তিন দিনের বাংলাদেশে অ্যাপারেলস অ্যান্ড সেফটি এক্সপোতে তুলে ধরা হয়, যার উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।

গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে  বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।


রোডম্যাপ ও আশাবাদ

এই রোডম্যাপে বলা হয়, লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগামি ৫/৬ বছরের মধ্যে সরকারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সেগুলি হচ্ছেঃ  চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতাবৃদ্ধি, ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেনের সড়কের কাজ শেষ, বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ, বিদেশী বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি এবং শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা।

“বিশাল এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব নয়। কারণ, ২০২১ সালে বিশ্বে পোশাকশিল্পের বাজার বেড়ে দাঁড়াবে ৬৫ হাজার কোটি ডলারে। বর্তমানে আছে ৪৫ হাজার কোটি ডলারের বাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৫ শতাংশ। এটি ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে পারলেই আমরা লক্ষ্য অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাব,” বেনারকে জানান বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম।

তার আশাবাদের কারণ তুলে ধরে বলেন, ২০১৩-১৪ অর্থবছর তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় ছিল দুই হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। পাঁচ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছতে হলে রপ্তানি আয় বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি করতে হবে।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, এর বিপরীতে আয় হয় ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ শতাংশ কম আয় হয়েছিল ওই অর্থবছর, যার তিন মাস কেটেছে রাজনৈতিক সহিংসতায়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বেনারকে বলেন, “ প্রত্যাশা পূরন করতে হলে  পোশাক খাতে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। সেইসঙ্গে আগামী ছয় বছরে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় ও মজুরি বাড়তে হবে। মালিকদের উচ্চ ব্যয় ও উচ্চ আয় এই কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করতে হবে। সে জন্য বর্তমানে কম মূল্যের পণ্যের চেয়ে বেশি মূল্যের পণ্য তৈরি ও রপ্তানির দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এসবের জন্য কারখানাগুলোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি আছে কি না, সেটাই বেশি জরুরি।

এদিকে ৪ আগস্ট দুপুরে চট্টগ্রামের খুলশীর বিজিএমইএ ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সহ-সভাপতি নাসিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী সংগঠনের এই লক্ষ্য নিয়ে কথা বলেন।

তিনি বলেন, “ গত বছরের সামিটে সরকারি-বেসরকারি খাত, দাতা সংস্থা, ব্র্যান্ড এবং শ্রমিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে টেকসই পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু পরামর্শ আসে। পরবর্তীতে আমরা অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (মেলবোর্নে অবস্থিত টেকনোলজি ও ডিজাইনের উপর বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)  সঙ্গে পরামর্শগুলো বিশ্লেষণ করে একটি রোডম্যাপ তৈরি করি।”


বাজার বাড়াতে হবে

আয়োজকেরা জানান, রেডিসন ব্লু হোটেলের মেজবান হলরুমের প্রদর্শনীতে এবার স্টল ছিল ৭৩টি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক (১৭টি), ফায়ার ইকুপমেন্টস (২৫টি), মেশিনারি (১৮টি), সার্ভিস প্রোভাইডার্স (সাতটি), বিজিএমইএ (দুইটি), গার্মেন্টস এক্সেসরিজ (দুইটি), ফেব্রিকস (একটি) ও গার্মেন্টস ফেব্রিকসের (স্থানীয়, একটি)।

প্রদর্শনীতে উদ্যোক্তা, বিশ্ববিখ্যাত ব্র্যান্ড, বিশেষজ্ঞ, বিনিয়োগকারী ও নীতি নির্ধারকেরা অংশ নেন।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা রপ্তানি বাড়ানো তালিকায়  ব্রাজিল, রাশিয়াসহ ‘ব্রিকস’ জোটভুক্ত পাঁচ উদীয়মান অর্থনীতির দেশকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাও  তাদের সম্ভাব্য বাজার।

ড. মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে পোশাক খাতে বড় বাজারের সঙ্গে অন্যান্য বাজারের গুরুত্ব বাড়ছে। পাশাপাশি চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, জাপান, রাশিয়া এবং আফ্রিকায় বাজার সৃষ্টি করতে হবে।


আছে শঙ্কাও

দেশের বর্তমান বিনিয়োগে মন্দা পরিস্থিতি, অবকাঠামোগত অনুন্নয়ন, অতিরিক্ত ব্যাংক সুদ হার, বিশেষ অর্থনৈতিক জোন (এসইজেড) প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের পোশাকের দাম কমে যাওয়া এই লক্ষ্য অর্জনে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

বিজিএমইএর মতে, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি দরকার প্রায় ১৩ শতাংশ। কিন্তু আগের বছর ২০১২-১৩ অর্থবছরে যেখানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ, পরের বছর প্রবৃদ্ধি হয় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।  তাই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে হলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দ্বিগুণ করতে হবে।

পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, কারখানার কর্মপরিবেশ ও শ্রমিক অসন্তোষ বিষয়ে ক্রেতাদের নেতিবাচক ধারণা, পোশাক খাত সম্পর্কে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অপপ্রচার এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ বেশ কয়েকটি কারণে এ লক্ষ্য অর্জন করা যাবে কি-না তা নিয়ে  সংশয় আছে।

ড. মোয়াজ্জেম বলেন, “বর্তমান বিশ্ববাজারে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ঘাটতি পূরণ করে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা চ্যালেঞ্জ হবে । তিনি বলেন, এজন্য উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি আরও ভালো পণ্য রপ্তানি করতে হবে। তৈরি পোশাক খাতে সংস্কার হচ্ছে বিদেশিদের কাছে এই ইতিবাচক বার্তা বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। সেইসঙ্গে পোশাক খাতের জন্য আরও বাজার তৈরি করতে হবে”।

“স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাড়লে, সব কারখানায় বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিশ্চিত ও ঢাকা-চট্টগ্রামের চারলেনের কাজ দ্রুত শেষ করা হলে লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা,” জানান বিজিএমইএর আরেক সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম।

সরকারের হিসাবে, ১৯৭৮ সালে ২টি গার্মেন্টস কারখানা দিয়ে যে শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেখানে আজ প্রায় ৪৫০০ কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমিক পাওয়ার কারণে বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম (চীন ও তুরস্কের পর) গার্মেন্টস রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে অবস্থান নিশ্চিত করেছে।

দেশের মোট রপ্তানি আয় বর্তমানে ৩১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে গার্মেন্টসের আয় ২৫ বিলিয়ন ডলার। মূলত রপ্তানির ৭৫ ভাগ আয় আসে গার্মেন্টস খাত থেকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।