তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকান্ডে ১৩ আসামীর বিচার শুরুর আদেশ

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2015.09.03
BD-garments তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকান্ডে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। ২৪ নভেম্বর,২০১২
অনলাইন

তিন বছর আগে ঢাকার আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসের শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনায়  অপরাধজনক প্রাণনাশের অভিযোগে গত বৃহস্প্রতিবার বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছে আদালত।

মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন,  তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ আসামী ১৩ জন।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১১ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ১০৪ শ্রমিক।

আগুন লাগার পর শ্রমিকদের বের হতে না দিয়ে তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বলে সে সময় অভিযোগ ওঠে।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এম কুদ্দুস জামান এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর জন্য ১ অক্টোবর দিন ঠিক করে দেন।
ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এই ১৩ আসামির বিচার হবে।

দোষী সাব্যস্ত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছেন এ আদালতের পিপি খন্দকার আবদুল মান্নান।


তাজরীন ফ্যাশনসের মামলা

তাজরীন ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতাসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

মামলা হওয়ার ১৩ মাস পর ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীন উজ জামান খান।
অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারা অনুযায়ী ‘অপরাধজনক নরহত্যা’ ও ‘অবহেলার কারণে মৃত্যুর’ অভিযোগ আনা হয়।

বৃহস্প্রতিবার অভিযোগ গঠনের সময় দেলোয়ার ও মাহমুদাসহ জামিনে থাকা সাত আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

পলাতক পাঁচজনের মধ্যে তাজরীনের প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ এদিন আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন।
এই আটজন নিজেদের নির্দোষ দাবি করে মামলা থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন।

অব্যাহতির আবেদনে দেলোয়ার ও মাহমুদা আক্তারের আইনজীবী টি এম আকবর বলেন, “তাজরীন ফ্যাশনস এর ভবন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই গার্মেন্ট করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। আগুনের সূত্রপাত আমার মক্কেলদের হাত দিয়ে নয়, তারা নিজেদের সম্পত্তিতে আগুন দেননি। ১৩৭ জন সাক্ষীর কেউ ১৬১ ধারার জবানবন্দিতে তাদের নাম বলেননি।”

বিচারক এ সময় আইনজীবীকে বলেন, “আপনাদের তো অবহেলা রয়েছে।”

জবাবে আকবর বলেন, “আমাদের কোনো অবহেলা ছিল না। ঘটনার পর একটি গেট খোলা রাখা হয়েছিল। দায়দায়িত্ব ছিল কর্মরত সংশ্লষ্ট ব্যক্তিদের।”

এ সময় বিচারক বলেন, “এটি বিচারের বিষয়। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হোক। আপনাদের যদি নির্দোষ থাকার গ্রাউন্ড থাকে তাহলে খালাস পেয়ে যাবেন।”

এ সময় এই আইনজীবী বলেন, “তাজরীন ফ্যাশনস একটি ফ্যামিলি কোম্পানি, আমরা মূল মালিক নই।”

আকবরের সহযোগী আইনজীবী এ টি এম গোলাম গাউস এ সময় প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন বিষয়ক কাগজপত্র আদালতে দাখিল করেন।

পরে রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী বলেন, “এ ঘটনায় ১১১ জন মারা গেছেন। একটি গেট খোলা রেখে সব গেট বন্ধ রাখা হয়েছিল, বাধ্য করা হয়েছিল একটি গেট দিয়ে বের হতে। এটা ছিল একটি হত্যাকাণ্ড।”

দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

আসামিদের মধ্যে দেলোয়ার, মাহমুদা ও মোর্শেদ ছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তা দুলাল, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, সিকিউরিটি সুপারভাইজার আল-আমিন, ইনচার্জ আনিসুর রহমান, স্টোর ইনচার্জ আল-আমিন জামিনে রয়েছেন।

আর কারখানা ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জু, কোয়ালিটি ম্যানেজার শহিদুজ্জামান দুলাল, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনারুল ও লোডার শামীম মিয়া পলাতক রয়েছেন।


রানাপ্লাজার মামলাও চলছে ঢিমে তালে

তাজরীনে আগুন লাগার ঘটনার রেশ না কাটতেই ২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন পোশাক শ্রমিক মারা যান।

সাভারে ধসে পড়া বহুতল ভবন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমকে ১ সেপ্টেম্বর কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। সোহেল রানাকে এর আগেই গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।

অবৈধভাবে ভবন নির্মাণের অভিযোগে দায়ের করা মামলায়  ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান মর্জিনা বেগম। শুনানি শেষে জামিন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন বিচারক এম আতোয়ার রহমান।

ঘটনার এক বছর পর গত বছরের ১৫ জুন ভবন নির্মাণে দুর্নীতি নিয়ে মামলাটি দায়ের করেন দুদকের উপপরিচালক এসএম মুফিদুল ইসলাম।
তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের কয়েক মাসের মধ্যে রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তার ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র তাদের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা (জিএসপি) বাতিল করে।


ছয়টি পোশাক কারখানা আন্তর্জাতিক মানের

তাজরীনের ঘটনা ও রানাপ্লাজা ধসের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য ক্রেতা কোম্পানিগুলো ২টি জোট গঠন করে। উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট এলায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট একোর্ড গঠিত হয়।

এদিকে গত দুই বছরে সব ধরনের সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে দেশের ছয়টি পোশাক কারখানা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হয়েছে। কারখানাগুলো হচ্ছে- গ্রীন টেক্সটাইল, কুন টং অ্যাপারেলস, লন্ড্রি ইন্ডাস্ট্রিজ, লেনি অ্যাপারেলস, অপটিমাম ফ্যাশনস ও ইউনিভোগ লিমিটেড। উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট এলায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি এই স্বীকৃতি দিয়েছে।

এলায়েন্স প্রতিষ্ঠার দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে  গত বৃহস্প্রতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন এই তথ্য জানানো হয়। এতে মূল বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশ নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক জেমস এফ মরিয়ার্টি।

‘আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি’ বাংলায় কথাগুলো বলে বক্তব্য শুরু করেন সাবেক এই মার্কিন রাষ্ট্রদূত। পরে ইংরেজিতে বক্তব্য দেন। যার বাংলা অনুবাদ এরকম, “সদস্য কারখানাগুলোর শতভাগ পরিদর্শন শেষ হয়েছে। এসব কারখানা ভবনের কাঠামোগত, বৈদ্যুতিক ও অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ছোট ও বড় ত্রুটি খুঁজে পাওয়া গেছে। এখন অ্যালায়েন্সের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংস্কার কার্যক্রম চলছে। ইতিমধ্যে ছয়টি কারখানা সব ধরনের ত্রুটি সংস্কার করে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান অর্জন করেছে”।

এলায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেসবাহ রবিন বলেন, “আটটি কারখানায় চূড়ান্ত পরিদর্শন হয়েছে। উত্তীর্ণ হয়েছে ৬টি। আগামী ১-২ দিনের মধ্যে কারখানাগুলোকে এই স্বীকৃতির সনদ দিয়ে দেওয়া হবে”।

তিনি আরো জানান, এলায়েন্সের সদস্য কারখানার সংখ্যা ৭৯০। এর মধ্যে সক্রিয় আছে ৬৬২টি। আর প্রথম সংস্কার যাচাই পরিদর্শন (আরভিভি) সম্পন্ন হয়েছে ৫২৮টি কারখানার।

এলায়েন্সের পাশাপাশি ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট কারখানা পরিদর্শন করছে। তাদের সদস্য কারখানার মধ্যে দুটি কনকর্ড ফ্যাশন এক্সপোর্ট লিমিটেড ও জিকন সব ধরনের ত্রুটি সংস্কার করেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৮টি কারখানা আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হলো।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।