বাংলাদেশের মজুদ গ্যাস চলবে আর মাত্র ১৬ বছর

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2015.06.30
BD-gas গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে, বাসাবাড়িতে এলএনজি গ্যাস চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। জুন,২০১৫
বেনার মিউজ

বাংলাদেশে ফুরিয়ে আসছে গ্যাসের মজুদ। এখনকার মজুদ দিয়ে আর মাত্র ১৬ বছর চলা যাবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই গ্যাস সংকট ভবিষ্যতে দেশে ব্যাপক জ্বালানি সংকট তৈরি করবে। বিদ্যুৎ ঘাটতিতে বন্ধ হবে কলকারখানার উৎপাদন। বিপাকে পড়বে দেশের গ্যাস নির্ভর অর্থনীতি।

জাতীয় সংসদের অধিবেশনে গত রোববার এক প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী  বলেছেন, “চলতি বছর জুন পর্যন্ত সময়ে ৮১৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এই হার অপরিবর্তিত থাকলে মজুদকৃত গ্যাস আরও প্রায় ১৬ বছর, অর্থাৎ ২০৩১ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা যাবে।”
এই গ্যাস সংকটের বিষয়টি মাথায় রেখে আগামী তিন বছরের মধ্যে আবাসিক খাতের ৭০ শতাংশ বাড়িতে প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিবর্তে সিলিন্ডার গ্যাস দেয়ার একটি পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে এবং এখনই গ্যাসের রেশনিং করা হচ্ছে বলে জানান জ্বালানী ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী।

এই জ্বালানীর সরবরাহ নিশ্চিত করতে নতুন গ্যাস খোঁজা ও আমদানীর দিকে সরকার নজর দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন নসরুল হামিদ।

বাংলাদেশে এ যাবৎ আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র ২৬টি। এর মধ্যে ২০টি বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোর প্রাথমিক গ্যাস মজুদ ছিল ২৭ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত বিভিন্ন খাতে ব্যবহার হয়েছে ১২ দশমিক ৯৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সেই হিসাবে বর্তমানে মজুদ রয়েছে আনুমানিক ১৪ দশমিক ১৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।

তবে “মজুদ থাকা গ্যাস আগামী ১৬ বছর চলবে’- মন্ত্রীর এ তথ্যও পুরোপুরি সঠিক নয় বলে যুক্তি দিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও গবেষক অধ্যাপক বদরুল ইমাম। এর কারণ ব্যাখায় তিনি বলেন, “গ্যাস উৎপাদন ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। তারপর এই প্রবাহ কমতে থাকবে। তখন ২০৩১ সাল পর্যন্ত চললেও গ্যাসের চাহিদা এবং সরবরাহে বিরাট পার্থক্য থাকবে।”

বেনারকে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিদ্যুত কেন্দ্র গ্যাস নির্ভর। এজন্য গ্যাসের বিকল্প জ্বালানিতে যেতে হবে। সে বিকল্প হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশেষ করে দেশীয় কয়লার উৎপাদনে জোর দিতে হবে। কিন্তু দেশের কয়লা ‍উত্তোলনের তেমন কোন ব্যবস্থা সরকার করেনি। সরকারের পরিকল্পিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রে বিদেশ থেকে কয়লা আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সেটার দাম পড়বে বেশি। এরফলে ভবিষ্যতে এখনকার মত সাশ্রয়ী মূল্যে আমরা বিদ্যুত পাব না। অতি মূল্য দিয়ে বিদ্যুত কিনতে হবে।”

এদিকে বেনারের সঙ্গে আলাপে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, গ্যাসের বিকল্প হিসেবে লিকুইয়িফাইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি আমদানির কথা ভাবছে সরকার। ইতিমধ্যে কাতারের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর হয়েছে। অন্যান্য দেশের কথাও ভাবা হচ্ছে।

মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মানেরও তোড়জোর চলছে বলে সরকারি সূত্রে জানা যায়। তবে বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে এলএনজি আমদানি কিছুটা বিলাসিতা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে বদরুল আলম বলেন, “এলএনজি খুবই ব্যয়বহুল জ্বালানি। এই জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুত তৈরি করলে বিদ্যুতের দাম অনেক বেশি পড়ে যাবে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। সেক্ষেত্রে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হলে দেশীয় কয়লা ব্যবহারে জোর দিতে হবে।”

একইসঙ্গে ভারত, নেপাল বা ভূটানের মত প্রতিবেশি দেশ থেকে বিদ্যুত কেনার কথা উল্লেখ করেন তিনি।
জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়া নিয়ে সরকার খুব একটা উদ্বিগ্ন নয়। কারণ জাপান কিংবা ইউরোপের অনেক দেশ গ্যাস আমদানী করেই অর্থনীতির চাহিদা মেটাচ্ছে।


কয়লা খনিগুলোর অবস্থা

দেশে ৫টি আবিষ্কৃত কয়লা খনির মধ্যে শুধুমাত্র দিনাজপুরের বড়ুপুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যগুলো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তের অভাবে এখনো ঝুলে রয়েছে। আর কয়লা নীতি প্রণয়ন নিয়ে লুকোচুরি চলছে ২০০৪ সাল থেকে। রিভিউয়ের পর রিভিউ চললেও চুড়ান্ত করা হচ্ছে না সেই নীতিমালা।

দেশীয় কয়লা খনির সম্ভাব্যতা সম্পর্কে জানা যায়, সরকারি হিসেবে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি, জয়পুর হাটের দীঘিপাড়া, রংপুরের খালাশপীর এবং বগুড়ার কুচমায়সহ পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব খনিতে মজুদ রয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৩’শ মিলিয়ন টন উন্নতমানের কয়লা।
দেশে একমাত্র বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর ভাষায়, এ খনি থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৩৫৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা আয় হয়েছে।

বড়পুকুরিয়া বাদে বাকি চারটি কয়লাখনির মধ্যে ফুলবাড়ির কাজ পেতে মরিয়া এশিয়া এনার্জি। তবে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এলাকাবাসির চরম অসন্তোষ রয়েছে। ফুলবাড়ি থেকে কয়লা তোলা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। আর দিঘীপাড়া খনির কাজ নিয়ে বসে আছে পেট্রোবাংলা।
তবে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে খালাশপীর খনি। এখান থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে চায় সমীক্ষাকারি কোম্পানি হোসাফ কনসোর্টিয়াম লিঃ। এই নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা নেই।

২০০৩ সালে সরকারের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে হোসাফ কনসোর্টিয়াম ও চায়নার সেন উইন মাইনিং গ্রুপকে খালাশপীর কয়লা খনি সমীক্ষার জন্য লাইসেন্স প্রদান করা হয়।

হোসাফ কনসোর্টিয়াম এবং সেন উইন মাইনিং গ্রুপ ট্রপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে এবং দ্বি-মাত্রিক ও ত্রি-মাত্রিক সিসমিক সার্ভে করে। ওই সার্ভের মাধ্যমে কয়লার মজুদ, পুরুত্ব,গভীরতা, চ্যুতি ও কয়লার বিস্তৃতি এবং স্তর সম্পর্কে পরীক্ষা চালায়। হোসাফ ২০০৬ সালে খনি উন্নয়নের আবেদন করে। কিন্তু সেই প্রস্তাব এখনও ঝুলে রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।